বিদ্যুৎ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দিনমজুর থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্টের বাসভবন, সকল স্থান আলোকিত করতে প্রয়োজন বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় পরিবাহী তারের মাধ্যমে। কেমন হতো যদি তারবিহীন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা থাকতো?
শুনতে সায়েন্স ফিকশনের মত শোনালেও এমন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বপ্ন অনেক আগেই রোপণ করে গিয়েছিলেন বিজ্ঞানী নিকলা টেসলা। যা এত দশক পর সম্ভবত বাস্তব-রূপ পেতে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ চাহিদার একটি বড় অংশ সরবরাহ হয় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত গ্রিন হাউস গ্যাস পরিবেশকে দূষিত করার পাশপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে এবং সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে উইন্ড মিল বা বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রও ভূমিকা রাখে তবে তাঁর জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র। অনেক উন্নত দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে যে নিউক্লিয়ার বর্জ্য বের হয় তা থেকে শত বছর পর্যন্ত ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় রশ্মি বের হতে থাকে। যা পরিবেশ এবং মানবদেহে শতবর্ষ দীর্ঘ প্রভাব ফেলতে পারে। যার ফলে নিউক্লিয়ার বর্জ্যগুলো বর্জ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও এর মধ্যে তেজস্ক্রিয়তা থেকে যায়। ফলে যেখানেই বর্জ্যগুলো সংরক্ষিত থাকুক না কেন, দুর্ঘটনাবশত হলেও পরিবেশের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাওয়ার তীব্র সম্ভাবনা থেকেই যায়। এর পাশাপাশি রয়েছে বিস্ফোরণের ঝুঁকি।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিস্ফোরিত হলে ওই এলাকা কয়েক দশকের জন্যে নরকে পরিণত হবে। চেরনোবিলের দুর্ঘটনার কথা তো আমাদের সকলেরই জানা। ১৯৮৬ সালে ঘটা এই দুর্ঘটনার প্রভাবের শিকার হতে হয়েছিল ইউরোপ জুড়ে নানা নবজাতক শিশুদেরও। এক কথায় এর ক্ষতি বর্ণনা করতে গেলে বিস্ফোরণের ফলে এই পাওয়ার প্লান্ট থেকে যে বর্জ্য বের হয়ে বায়ুমন্ডলের সাথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গরুর খাবারের ঘাসে গিয়ে মিশে যায়। ওই গরুর দুধ খাওয়ার ফলে প্রায় ২০ হাজার শিশু থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল। আর দুর্ঘটনার এলাকায় ঘটে যাওয়া বিপর্যয় তো আছেই।
এই সকল সমস্যার সমাধান নিয়ে সামনে এসেছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা Space Solar। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমানোর লক্ষ্যে তারা কাজ করেছেন এবং অবশেষে সৌরবিদ্যুৎকে তারবিহীন সরবরাহের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
তবে কীভাবে এই সৌরবিদ্যুৎ তারবিহীন পদ্ধতিতে সরবরাহ করা হবে?
সৌর শক্তি তথা সূর্যের তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উৎপন্ন বিদ্যুৎ শক্তিই হলো সৌর বিদ্যুৎ। সোলার প্যানেল নামের বিশেষ প্লেটের সাহায্যে এই রূপান্তরের কাজটি করা হয়। বর্তমানে সোলার প্যানেল বৃহৎ পরিসরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার মতো করে উৎপাদন হয়না, কারণ এর জন্যে বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকা এবং নিরবচ্ছিন্ন সূর্যের আলো প্রয়োজন। ভূমি স্বল্পতা এবং ঋতু পরিবর্তনের জন্যে এই উপায় অবলম্বন সম্ভব নয়। তাই মহাকাশকেই বেছে নিয়েছে Space Solar। তাদের পরিকল্পনা, মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষপথে সোলার প্যানেল যুক্ত মহাকাশযান বসানোর মাধ্যমে ২৪/৭ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা।
ভূপৃষ্ঠ হতে ২২০০০ মাইল (৩৬০০০ কিলোমিটার) দূরে geostationary orbit-এ স্থাপন করা হবে মহাকাশযানটিকে। যেখান থেকে নিরবিচ্ছিন্ন সূর্যের আলো পাওয়া সম্ভব হবে। তারা এই মিশনটিতে ব্যবহৃত মহাকাশযানটির নাম দেন ক্যাসিওপিয়া (CASSIOPeiA)।
CASSIOPeiA দ্বারা উৎপন্ন বৈদ্যুতিক শক্তি উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও তরঙ্গে রূপান্তরিত হবে, যা লেজার বিম রূপে পৃথিবীতে তৈরিকৃত রিসিভিং স্টেশনে এসে পৌঁছাবে, যেখানে তারা আবার তা বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করবে। পরীক্ষকেরা একটি নির্ভুল নির্দেশক ব্যবস্থাও পরীক্ষা করেছে যা নিশ্চিত করবে যে তরঙ্গগুলো রিসিভিং স্টেশনের আশেপাশে বসবাসকারী মানুষের জন্য কোনও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে না।
পরীক্ষা সফল হওয়ার পর, Space Solar এর সহ-সিইও মার্টিন সোলটাউ একটি ইমেইল বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের প্রযুক্তির বিকাশের পরবর্তী ধাপটি প্রদর্শন করতে পেরে আমরা রোমাঞ্চিত,” তিনি আরও জানান, “স্পেস সোলারের সফল পরীক্ষা মহাকাশ-ভিত্তিক সৌর শক্তিকে বিপ্লব করার জন্য আমাদের মিশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত চিহ্নিত করে।”
ইউকে স্পেস এজেন্সির প্রধান নির্বাহী পল বেট, যিনি প্রকল্পটি সমর্থন করেন, একটি পৃথক বিবৃতিতে বলেন, “এই সফল পরীক্ষাটি স্থানভিত্তিক সৌর শক্তিকে বাস্তবে পরিণত করার পথে একটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। নিরাপদ, ওয়্যারলেস এনার্জি ট্রান্সমিশন একটি গেম চেঞ্জার এবং এই নতুন শক্তি বিপ্লবে যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় অবস্থান প্রদর্শন করে, যা আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীর জীবনকে উপকৃত করার জন্য মহাকাশের শক্তিকে ব্যবহার করে।”
গবেষকরা অনুমান করেন, একটি একক CASSIOPeiA প্ল্যান্ট এক মিলিয়নেরও বেশি বাড়িকে বিদ্যুৎ সরবারহ করতে পারবে। মহাকাশে সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো, যদিও নির্মাণ করা কঠিন, পৃথিবীতে থাকা প্ল্যান্টগুলির তুলনায় ১৩ গুণ বেশি দক্ষতার সাথে শক্তি উৎপাদন করবে।
অর্থাৎ, ধারণা করা যায়, এই দশকের মধ্যেই শত বছর আগে দেখা টেসলার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে।
কৃষ্ণ দেব নাথ / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: স্পেস.কম