কোভিড-১৯ এর দ্রুত এবং সহজলভ্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা মানুষকে সরাসরি সুযোগ দিয়েছে দ্রুততর সময়ে এবং কম খরচে চিকিৎসা লাভের মূল্য বোঝার। এবারে গবেষকরা দেখিয়েছেন কীভাবে বায়োচীপ দ্বারা একসাথে অতি অল্প সময়ে হাজার হাজার আণবিক স্ক্রিনিং পরিচালনা করতে হয়। এই প্রযুক্তিতে আলো ব্যবহার করে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিলিকন ব্লকের একটি বিন্যাসের উপরে আটকে থাকা অণু চিহ্নিত করা হয়।
প্রথমে দেখা যাক বায়োচীপ জিনিসটা আসলে কী। আণবিক জীববিজ্ঞানে বায়োচীপ হলো প্রকৌশল করা কতগুলো বিশেষ স্তর বা ক্ষুদ্র ল্যাবরেটরি যেগুলো একযোগে প্রচুর সংখ্যক জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটন করতে পারে।
তাত্ত্বিকভাবে, এই বায়োচীপগুলোর একটি একক বর্গসেন্টিমিটার স্থানের মধ্যে ১৬০,০০০টি বিভিন্ন অণু চিহ্নিত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। মূলত SARS-CoV-2 ভাইরাস এবং অন্যান্য সংক্রামক জীবের জিনের টুকরো শনাক্ত করার জন্য তৈরি করা হলেও প্রযুক্তিটি দ্বারা ক্যান্সারের প্রোটিন চিহ্নিতকারী এবং পরিবেশের জন্য বিষাক্ত এমন হুমকিস্বরূপ ছোট ছোট অণুও শনাক্ত করতেও সক্ষম হতে পারে।
আণবিক জীববিজ্ঞানী এবং মন্টেরি বে অ্যাকোয়ারিয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সভাপতি ও সিইও ক্রিস স্কোলিন বলেছেন,
“পরিবেশের বিভিন্ন পদার্থগুলো আমরা যেভাবে শনাক্ত করি তাতে এই প্রযুক্তির একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে৷ বায়োচীপটি বিভিন্ন রোগের কারণ নির্ণয়ে (ক্লিনিক্যাল ডায়াগনস্টিকস) উপযোগী হতে পারে, যদিও এর বেশ কিছু প্রতিযোগী প্রযুক্তি ইতিমধ্যে ব্যাপক ব্যবহারে রয়েছে।”
জেনেটিক পরীক্ষা নতুন কিছু নয়। এই প্রযুক্তিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে জিনের সাথে সংযুক্ত করার জন্য তৈরি করা সূক্ষ্ম অণুসমূহ (প্রোব মলিকিউলস) থেকে আলোর শোষণ বা নির্গমন পরিমাপের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এই পরীক্ষা দ্বারা কোনো কিছু শনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট বড় একটি সংকেত তৈরি করতে হয়।
এই কাজে বেশিরভাগ প্রযুক্তি শনাক্ত করার চেষ্টা করার আগে টার্গেটের অনেক কপি তৈরি করে নেয় পলিমারেজ চেইন প্রতিক্রিয়ার মতো পরিবর্ধক কৌশলগুলোর সাহায্যে। যা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। গবেষকরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরনের সংবেদনশীল প্রযুক্তি তৈরি করেছেন।
যার প্রেক্ষিতে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফলিত পদার্থবিজ্ঞানী জেনিফার ডিওন বলেন,
“পূর্ববর্তী সেন্সরগুলো প্রশস্ত পরিসরে টার্গেট মলিকিউলস শনাক্ত করতে সক্ষম হয়নি।”
এ সকল সমস্যা সমাধানের আশায় ডিওন এবং তার সহকর্মীরা একটি অপটিক্যাল ডিটেকশন পদ্ধতির দিকে এগোন যা মেটাসারফেস (যে কোনো দিকনির্দেশে প্রচুর সংখ্যক উপাদান রয়েছে এমন কাঠামো) এবং ছোট ছোট সিলিকন বাক্সগুলোর বিন্যাসের উপর নির্ভর করে।
প্রতিটি বক্স মোটামুটি ৫০০ ন্যানোমিটার উঁচু, ৬০০ ন্যানোমিটার দীর্ঘ এবং ১৬০ ন্যানোমিটার প্রশস্ত – যা বিন্যাসের উপরের পৃষ্ঠে সন্নিকট অবলোহিত রশ্মি (Near Infrared Light) ফোকাস করে। এই ফোকাসিং একটি সাধারণ অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপের জন্য প্রতিটি সিলিকন ব্লক থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন শনাক্ত করা সহজ করে তোলে। এই পরিবর্তন নির্ভর করে পৃষ্ঠের উপরে কোন অণু অবস্থান করছে তার উপর।
ধারণাটি পরীক্ষা করার জন্য গবেষকরা সিলিকন ব্লকগুলোর সাথে ২২ টি নিউক্লিওটাইডের সমান লম্বা এক সূত্রক জিনের টুকরো বাঁধেন এবং বিন্যাসটিকে একটি বাফার দ্রবণে নিমজ্জিত করেন। যখন তারা দ্রবণে পরিপূরক ডিএনএ সূত্রকগুলো যোগ করেন তখন সেগুলো দ্রুত বন্ধনযুক্ত জিন টুকরোর সাথে আবদ্ধ হয়।
যা প্রতিটি বাক্সের পৃষ্ঠ থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে স্থানান্তরিত করে। ডিওন এবং তার সহকর্মীরা রিপোর্ট করেছেন যে তাদের সেটআপ প্রতি মাইক্রোলিটারে ৪০০০ কপি টার্গেট জিনের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে, যার ফলাফল তারা ন্যাচার কমিউনিকেশন (Nature Coomunications) পত্রিকায় প্রকাশ করেছে।
ডিওন বলেছেন,
“এটি এমন একটি ঘনত্ব যা সাধারণত SARS-CoV-2 আক্রান্ত ব্যক্তির অনুনাসিক নমুনায় উপস্থিত থাকে।”
তাই এই কৌশলটি ডাক্তারদের প্রথমে রোগীর জেনেটিক উপাদানকে ব্যবহার না করেই ভাইরাল সংক্রমণ শনাক্ত করতে অনুমতি দিতে পারে।
তিনি উল্লেখ করেছেন,
“টার্গেট ডিএনএ কতটা আবদ্ধ হয়েছে তা প্রকাশ করার জন্যও বিন্যাস সাজানো সম্ভব। এতে করে কেবল একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসের উপস্থিতিই না বরং ইনফেকশন কতটা তীব্র তাও কয়েক মিনিটের মধ্যেই শনাক্ত করা যাবে।”
এই ধরনের তথ্য চিকিৎসাক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কাজে অনেক সাহায্য করতে পারে। বর্তমান পরীক্ষাগুলোও এটি করতে পারে তবে তারা শুধু জেনেটিক উপাদানকে বিশ্লেষণ এবং ফলাফলের পরিমাণ নির্ধারণ করতেই কয়েক ঘণ্টা সময় নেয়।
স্কোলিন যুক্তি দেন যে বায়োচীপ প্রযুক্তিটি ল্যাব বা ডাক্তারের অফিস ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরো তাৎক্ষণিক এবং ব্যাপক ব্যবহার খুঁজে পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বর্তমানে জলপথে বিষাক্ত শৈবাল শনাক্ত করতে সূক্ষ্ম জেনেটিক অণু (জেনেটিক প্রোব) ব্যবহার করেন।
তবে এর জন্য সাধারণ টার্গেট জিনগুলোকে প্রশস্ত করতে অতিরিক্ত প্রক্রিয়াকরণের প্রয়োজন এবং এরপরে তাদের বিস্তারের জন্য আলাদা পরীক্ষা করতে হয়। ল্যাবের এসব কাজে কয়েক ঘণ্টা এমনকি কয়েক দিন সময় ও লাগতে পারে।
স্কোলিনের মতে,
“এমন পরিস্থিতিতে বায়োচীপের গতি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে”। তিনি বলেছেন, “আরেকটি প্রলোভনসঙ্কুল বিকল্প হলো সিলিকন বাক্সের বিন্যাসের উপরে অ্যান্টিবডি সংযুক্ত করা। এটি গবেষকদের সংশ্লিষ্ট অ্যান্টিজেন শনাক্ত করতে সরাসরি সাহায্য করে যা বিষ বা রোগের প্রোটিন শনাক্ত করে।”
তিনি স্ট্যানফোর্ড টিমের শনাক্তকারক ব্যবহার করে দেখতে চান যে তারা সরাসরি পানিতে বিষাক্ত জীবাণু (মাইক্রোবিয়াল টক্সিন) শনাক্ত করতে পারেন কিনা।
স্কোলিন বলেছেন,
“এটি মানুষ, বাস্তুশাস্ত্র এবং বন্যজীবনের উপর সত্যিকারের প্রভাব ফেলবে।”
ডিওন এবং তার সহকর্মীরা তাদের নতুন ডিটেক্টরকে বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য পাম্পকিনসিড বায়ো নামে একটি কোম্পানি গঠন করেছে, প্রোটিন এবং অন্যান্য অণুগুলোর মিনিট স্তর শনাক্ত করার লক্ষ্যে।
যেহেতু স্বতন্ত্র লক্ষ্য অণুগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য শুধুমাত্র অল্প সংখ্যক সিলিকন ব্লকের প্রয়োজন হবে সেহেতু গবেষকরা একই সাথে অনেক রোগের বায়োমার্কার চিহ্নিত করতে নিজেরাই বিন্যাস তৈরি করতে সক্ষম হবেন।
ডিওনের ল্যাবের প্রাক্তন স্নাতক ছাত্র এবং নতুন স্টার্টআপের প্রধান জ্যাক হু বলেছেন,
“আমরা একই সময়ে অনেক রোগের অবস্থা দেখার আশা করি। এটাই আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য।”
শাহলীন রাহনুমা / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্স.অর্গ