“ফেসবুক কি তবে মেটাভার্স কোম্পানিতে পরিবর্তিত হচ্ছে?” এমন এক শিরোনাম গত কয়েকদিন ধরে ঘুরে ফিরে আসছে প্রযুক্তি জগতে। এখন যেসব প্রশ্ন জনমনে ভাসছে তার মধ্যে একটা প্রধান জিনিস হলো- “ইউনিভার্স শুনছি, মাল্টিভার্স শুনছি, এই মেটাভার্স জিনিস টা কি?!” এখন আপনার মনে আরো তিনটা প্রশ্ন চলে এসেছে,
১. মেটাভার্স কী?
২. ফেসবুক মেটাভার্স এ টার্ণ নিলে কেমন হবে?
৩. এটা আদৌ বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা?
তার আগে চলুন ছোট্ট একটা ঘটনা বা ভাবনা-চিন্তা দিয়ে শুরু করা যাক।
ধরুন, এই লকডাউনে আপনি বাসায় বসে কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে আছেন, এই সময়ে সহকর্মীদের সাথে আড্ডা দিতে পারলে কত মজাটাই না হতো। কিন্তু আপনি তো বাস্তবে মিলিত হতে পারবেন না, কেমন হয় যদি এমন একটি ব্যবস্থা করা যায় যে আপনার অনলাইনে হ্যাং আউট করছেন, কিন্তু অনুভূতিটা বাস্তবেই পেয়ে যাচ্ছেন, কিংবা অনলাইনেই কনসার্টে অংশ নিলেন কিন্তু অনুভূত হলো আপনি বাস্তবেই সেই কনসার্টে ছিলেন, এটা আদৌ সম্ভব কি?!
কেউ হয়তো মনে করবেন, পুরোটাই অসম্ভব, বাস্তবের আবার অনুভূতি পাওয়া যায় নাকি? আবার কেউ হয়তো ধরে ফেলবেন এখানে কিসের কথা বলা হয়েছে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কথাই বলছি!
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি– ব্যাপারটা যে অসম্ভব তা নয়, কিন্তু গেমিং কিংবা নির্দিষ্ট কিছু প্ল্যাটফর্ম ছাড়া তো এর চলই নেই।
এখন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আর মেটাভার্স এর কী সম্পর্ক?!
মেটাভার্স একটি কালেক্টিভ ভার্চুয়াল শেয়ার্ড স্পেস যা সমস্ত ভার্চুয়াল জগতের এবং ইন্টারনেটের সমষ্টি। এতে বাস্তব জগতের ডেরিভেটিভস বা কপি থাকতে পারে, কিন্তু এটি বাস্তবতা থেকে আলাদা। “মেটাভার্স” শব্দটি প্রিফিক্স “মেটা” অর্থাৎ “বাহিরে”এবং স্টেম “verse” (Universe এর ব্যাকফর্ম) দিয়ে গঠিত। এই শব্দটি সাধারণত ইন্টারনেটের ভবিষ্যতের পুনরাবৃত্তির ধারণা বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়, যা 3D ভার্চুয়াল স্পেস দিয়ে গঠিত।
মেটাভার্স হচ্ছে এমন একটা অনলাইন জগৎ, যেখানে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের মধ্যেই গেমিং, অফিসের কাজ এবং যোগাযোগ- সবকিছুই করতে পারবেন ইউজাররা। বর্তমান পরিকল্পনায় কাজটি হবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা ভিআর হেডসেটের সাহায্যে। ডিজিটাল দুনিয়ায় সবাই দেখাশোনা, মেলামেশা করবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে।
‘মেটাভার্স’ শব্দটি এসেছে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত নিল স্টিফেনসনের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস ‘স্নো ক্র্যাশ’ থেকে। উপন্যাসে ইন্টারনেটের পরবর্তী জগৎ হিসেবে ‘মেটাভার্স’-এর কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ‘মেটাভার্স’-এর কিছু ফিচার “অ্যানিম্যাল ফার্ম”, “ফোর্টনাইট” এবং “রোব্লক্স”-এর মতো গেমে ব্যবহার করার চেষ্টাও করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। গেমে কনসার্ট বা টুর্নামেন্টের মতো লাইভ ইভেন্ট আয়োজন করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গেমারদের মেলামেশার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট দ্য ভার্জকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফেসবুক নিয়ে জাকারবার্গ তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ‘এইভাবে যোগাযোগ করার জন্য মানুষের সৃষ্টি হয়নি।’ তিনি এমন ইন্টারনেট ব্যবস্থা তৈরি করবেন যেখানে আপনি শুধু কনটেন্ট দেখবেন না, আপনি নিজে এর ভেতরে থাকবেন, আপনি তারই একটা পার্ট হয়ে দাঁড়াবেন।
‘মেটাভার্স’-এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে থ্রিডি কনসার্টে ভার্চুয়ালি নাচার সম্ভাবনার কথা বলেন জাকারবার্গ। ‘আপনি অন্যদের সঙ্গে উপস্থিত থাকার অনুভূতি পাবেন, যেন আপনি অন্য কোথাও আছেন। যেটা দ্বিমাত্রিক ফেসবুক অ্যাপ বা ওয়েব পেজে সম্ভব নয়।’ অর্থাৎ এক জায়গায় থেকে একই সময়ে অন্য জায়গায় অন্য মানুষের সঙ্গে ভিন্ন পরিবেশ উপভোগ করার সুযোগ পাবে মানুষ।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ‘ইনফিনিট অফিস’ বা ব্যবহারকারীদের আদর্শ কর্মস্থল সেবা তৈরিতে কাজ করছে ফেসবুক। ২০১৪ সালে ২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ভিআর কোম্পানি ‘অকুলাস’ কিনে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালে ‘ফেসবুক হরাইজন‘ সেবা চালু করে ফেসবুক। ওই ‘ইনভাইটেশন-অনলি’ বা আমন্ত্রণভিত্তিক ভার্চুয়াল জগতে ব্যবহারকারীরা অকুলাস হেডসেট ব্যবহার করে কার্টুন অ্যাভাটার-এর মাধ্যমে কথা বলা বা মেলামেশার সুযোগ পান। তবে বর্তমানের হেডসেটগুলোর মতো মাথায় এত বড় যন্ত্র লাগিয়ে থাকাও যাবে না।
তবে তার দাবি, ফেসবুকের ‘মেটাভার্স’ যে কোনো প্ল্যাটফর্ম থেকে ব্যবহার করা যাবে, এর মধ্যে আছে ভিআর, এআর (অগমেন্টেড রিয়ালিটি), পিসি, মোবাইল ডিভাইস এবং গেমিং কনসোল। রয়টার্স এর মতে, ফেসবুক ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি খাতে বেশ বড় রকমের বাজেট বরাদ্দ করেছে। তারা রিস্টব্যান্ড প্রযুক্তি, এআর গ্লাস ও অকুলাস ভিআর হেডসেট নিয়ে ডেভেলপমেন্টের কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি এ ছাড়া অনেকগুলো ভিআর গেমিং স্টুডিও কিনেছে। সঙ্গে রয়েছে বিগবক্স ভিআর। আর এসব কাজে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১০ হাজার কর্মী নিয়োগ করেছে।
এখন আপনার কি মনে হয়, ফেসবুক মেটাভার্সে পরিণত হওয়াটা কেমন ইফেক্টিভ হতে পারে?
মিথিলা ফারজানা মেলোডি/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথসূত্রঃ বিজনেস ইনসাইডার, টেক ক্রাঞ্চ, দ্য নিউইয়র্কার, বিবিসি