কেমন হয় যদি প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে এমন উপাদান থাকে যা পানি থেকে অতিরিক্ত পুষ্টি শোষণ করতে পারে এবং এটি পচে যাওয়ার সময় সার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে? জি, সেই পণ্যটিই হলো বায়োপ্লাস্টিক। যেটি তৈরি করেছে ইউনিভার্সিটি অফ সাসকাচোয়ান (ইউএসআস্ক)-এর রসায়নের অধ্যাপক ড. লি উইলসন এবং তার গবেষণা দল।
গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি রয়্যাল সোসাইটি অফ কেমিস্ট্রি সাসটেইনেবিলিটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা দলটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছে পিএইচডি প্রার্থী বার্ন্ড জি কে স্টেইগার, বিএসসি ছাত্র ন্যাম বুই এবং পোস্টডক্টরাল সহ শিক্ষার্থী বোলানলে এম. বাবালোলা। গ্লোবাল ইনস্টিটিউট ফর ওয়াটার সিকিউরিটি (জিআইডব্লিউএস) এর সদস্য উইলসন এবং তার গবেষণাগারের দল ‘বায়োপ্লাস্টিক‘-এর বিকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন। তারা লক্ষ্য করেন এমন একটি উপাদান যা দেখতে প্লাস্টিকের মতো কিন্তু জৈবিক পদার্থ বা বায়োমেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি।
বিশ্বব্যাপী নির্মাতারা বছরে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করে। যার প্রায় ৯৯ শতাংশ তৈরিতে অপরিশোধিত তেল এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। পেট্রোলিয়াম প্লাস্টিকগুলি নষ্ট না হয়ে শতাব্দী ধরে অপচনশীল অবস্থায় থেকে যেতে পারে। আর যদি পুড়ে যায় তাহলে এই প্লাস্টিকগুলি বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন করে যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে এক বিরাট সমস্যার জন্য দায়ী।
এটি একটি সমস্যা কারণ প্লাস্টিকের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আমাদের নিত্যব্যাবহার্য পণ্যগুলিকে ধরে রাখতে, মোড়াতে এবং আটকানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই পেট্রোলিয়াম-ভিত্তিক উপকরণগুলি বাজারে আধিপত্য বজায় রাখে। বিশেষ করে মুদি এবং অন্যান্য খুচরা দোকানে যেখানে অনুমান অনুসারে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী এক ট্রিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ বিতরণ করা হয়।
এর সমাধান খুঁজতে প্রতিনিয়ত লেগে আছেন গবেষকরা। প্লাস্টিকের মতো বায়োপ্লাস্টিকগুলিও বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন: বাক্স বা খাবার রাখার জন্য এবং প্লাস্টিকের ব্যাগের মতো প্যাকিং উপকরণ হিসেবে। এই বায়োপ্লাস্টিক উপাদানটি একটি বায়োকম্পোজিট পেলেট যা একটি সামুদ্রিক পলিস্যাকারাইড (চিটোসান), ডিমের খোসা এবং গমের খড়ে থাকে। পেলেটটি তার নিজস্ব ‘বন্ধ লুপ‘ উপাদান যা জলের উত্স থেকে ফসফেট শোষণ করে। তারপরে কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগে সার উত্স হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
উইলসন বলেছিলেন,
“আমরা একটি বায়োপ্লাস্টিক উপাদান তৈরি করেছি যা একটি শোষণকারী হিসাবে কাজ করে। এটি জল থেকে ফসফেটকে বের করে নেয়। ভূপৃষ্ঠের জলে ফসফেট এর উচ্চ মাত্রা একটি বিশাল বৈশ্বিক জল সুরক্ষা সমস্যা । আপনি সেই গুলি সংগ্রহ করতে পারেন এবং একটি কৃষি সার হিসাবে বিতরণ করতে পারেন।”
বিশ্বজুড়ে খাদ্য জলের উৎসে ফসফেটের আধিক্য জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধির কারণ হতে পারে যেমন নীলাভ সবুজ শৈবাল । নীলাভ সবুজ শৈবালগুলি বিষাক্ত পদার্থ নির্গত করতে পারে যা মানুষ এবং প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকারক। ফসফেট একটি অ-নবায়নযোগ্য সম্পদ।
এই বন্ধ লুপ সিস্টেমটি ফসফেট খনির একটি বিকল্প সমাধান এবং পরিবর্তে জলের উত্সগুলিতে ইতিমধ্যে উপস্থিত পুষ্টি ব্যবহার করে।
উইলসনের ব্যাখ্যানুযায়ী,
“যখন এই (প্লাস্টিক) পরিবেশে ভেঙ্গে যায়, তারা আসলে মাইক্রোপ্লাস্টিক গঠন করবে।মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি তাদের শারীরিক আকারে এক মাইক্রন স্তরের এবং নীচের। তাদের মধ্যে প্লাস্টিকাইজার এবং অন্যান্য রাসায়নিক রয়েছে যা জলকে দূষিত করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন,
“প্লাস্টিক ছোট ছোট কণাতে ভেঙ্গে খাদ্যে প্রবেশ করতে পারে এবং কোষে প্রবেশ করতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি সমুদ্রে, ভূগর্ভস্থ জলে, গাছপালাগুলিতে প্রবেশ করতে পারে যা সংগ্রহ করা হয় এবং খাদ্যে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। আপনি যদি আপনার বাড়ির উঠোনে একটি প্লাস্টিকের মার্জারিন কন্টেইনার রাখেন এবং এটি পুঁতে রাখেন তবে এটি ৫০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে থাকতে পারে যতক্ষণ না এটি ভেঙে যেতে শুরু করে।
কিন্তু এটি সেই ক্ষুদ্র কণা যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বায়োপ্লাস্টিকের সাহায্যে আপনি সেগুলি এড়াতে পারেন এবং আপনি মূলত এমন কিছু পেতে পারেন যা এর মূল উপাদানগুলিতে ভেঙে যায় বা আরও সহজে কম্পোস্ট বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবনমিত হতে পারে।”
উইলসন যোগ করেন,
“পরিবেশের উপর সিন্থেটিক উপকরণ এবং প্লাস্টিক হ্রাস করাও প্রভাব ফেলবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি প্লাস্টিকটি ৯০ শতাংশ বায়োপ্লাস্টিক এবং ১০ শতাংশ সিন্থেটিক দিয়ে তৈরি হয় তবে এটি পরিবেশের সামগ্রিক লোডকে কমিয়ে দেবে। প্লাস্টিকটিকে আরও সহজে ভেঙে যেতে দেবে।”
এর আগেও আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির (ACS) ২৫১ তম জাতীয় সভা ও প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীদের রিপোর্ট অনুযায়ী এমন এক পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছিলো যেখানে বলা হয়েছিল বায়োপ্লাস্টিকের সাথে ডিমের খোসার ক্ষুদ্র অংশ যোগ করলে এটি একটি প্রথম ধরনের বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং উপাদান তৈরি করতে পারে যা বেঁকে যায় কিন্তু সহজে ভাঙ্গে না।
সেই গবেষণাটিতে আংশিকভাবে তারা ডিমের খোসা বেছে নিয়েছিল কারণ তা ছিদ্রযুক্ত, হালকা ওজনের এবং প্রধানত ক্যালসিয়াম কার্বনেট দ্বারা গঠিত একটি প্রাকৃতিক যৌগ যা সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।গবেষকরা দেখেছিল যে এই সংযোজন মিশ্রণটিকে অন্যান্য বায়োপ্লাস্টিক মিশ্রণের তুলনায় ৭০০ শতাংশ বেশি নমনীয় করেছিল।
যে সব স্থানে প্লাস্টিকের আবর্জনা ধীরে ধীরে বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে বায়োপ্লাস্টিকের ব্যাগ একটা দারুণ সমাধান হতে পারে৷ ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণার ফলে বায়োপ্লাস্টিকের মতো পণ্য আমাদের মানবজীবনে বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রাখবে বলে অনুমান করা যায়।
সাদিয়া সুলতানা হিমু / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ফিজিক্স.অর্গ, সায়েন্স ডেইলি