২৭ এপ্রিল, ২০১৬। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ হালেকোলা মানমন্দিরে (Haleakala Observatory) Pan-STARRS টেলিস্কোপ এর পর্যবেক্ষণে একটি নতুন গ্রহাণু পরিলক্ষিত হয়। এটি বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম, নিকটস্থ এবং সবচেয়ে স্থিতিশীল গ্রহাণু। সেজন্য এটিকে Quasi-moon বা দ্বিতীয় চাঁদ বলা হয়।
সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান গ্রহাণুর কক্ষপথটি পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে অনেকটা মিলে যায়। তবে গ্রহাণুর কক্ষপথ একটু সম্প্রসারিত এবং ঢালু। গ্রহাণুটির নাম দেয়া হয় 469219 Kamoʻoalewa বা Kamoʻoalewa. এই শব্দটার অর্থ ‘দোদুল্যমান স্বর্গীয় বস্তু’।
পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে ঘূর্ণায়মান গ্রহাণুটির গড় পর্যায়কালও পৃথিবীর মতো ৩৬৫ দিন। ৪০ থেকে ১০০ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট এই গ্রহাণুটি তার নিজ অক্ষে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একটি উপবৃত্তাকার পথে ঘুরে।
প্রাথমিক দিকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছিলেন যে, পৃথিবীর কক্ষপথের কাছাকাছি এই ধরনের বস্তুগুলো মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মাঝামাঝি গ্রহাণুপুঞ্জ গুলোর কোনো খণ্ডিত অংশ। তবে ২০২১ সালে, বৃহৎ বাইনোকুলার টেলিস্কোপ এবং লোয়েল ডিসকভারি টেলিস্কোপ দ্বারা পরিচালিত একটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, এই গ্রহাণুর উপাদান অনেকটা চাঁদের সাথে মিলে যায়। তখন থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি চাঁদের একটি খণ্ডিত অংশ।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় Kamoʻoalewa চাঁদের ঠিক কোন জায়গা থেকে এসেছে এবং এটির আকার আকৃতি কেমন এসব তথ্য উঠে এসেছে । চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইফেই জিয়াও এর নেতৃত্বে এক গবেষক দলের গবেষণা Nature Astronomy জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
সংখ্যাসূচক কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, Kamoʻoalewa চাঁদের গর্ত জিওর্দানো ব্রুনো(Giordano Bruno Crater) থেকে উদ্ভূত। জিওর্দানো ব্রুনো চাঁদের উলটো পাশের (যে পাশ সচরাচর পৃথিবী থেকে দেখা যায় না) ২২ কিলোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট একটি গর্ত।
ফ্রান্সের গবেষণা প্রতিষ্ঠান CNRS এর সিনিয়র গবেষক পেট্রিক মিশেল জানান,
“আমাদের প্রধান অনুসন্ধান হল Kamoʻoalewa চাঁদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, কোনো গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে নয়; যা বেশিরভাগ NEO(Near Earth Object) গ্রহাণু থেকে ভিন্ন।”
তারা কম্পিউটারাইজড মডেল ব্যবহার করে একটি অনুরূপ সংঘর্ষের সিমিউলেশন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যেটির মাধ্যমে Kamoʻoalewa এর মত পাথর খণ্ড চাঁদ থেকে বিভক্ত করে মহাকাশে ছুঁড়ে দেওয়া যাবে। তারা অনুমান করছেন যে, চাঁদে আঘাতকারী গ্রহাণুটির প্রস্থ প্রায় 1 মাইল (1.6 কিলোমিটার) যা জিওর্দানো ব্রুনো গর্ত করতে সক্ষম এবং Kamoʻoalewa কে মুক্ত করতে পেরেছিল।
গবেষক প্যাট্রিক মিশেল বলেন,
“এই ফলাফল গুলো আমাদের বলে যে Kamoʻoalewa চন্দ্র পৃষ্ঠের একটি খণ্ড হতে পারে। যদি আমাদের ধারণা ভুল না হয় তবে আমরা ধরে নিতে পারি পরিচিত গর্ত(জিওর্দানো ব্রুনো) এর সাথে Kamoʻoalewa এর একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।”
চাঁদের বিভিন্ন গর্তের সংঘর্ষ সম্পর্কে আরও জ্ঞানলাভ, আগামীতে গ্রহাণুর মধ্যে সংঘর্ষের মাধ্যমে কোনো মহাকাশীয় শিলা পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে কিনা তা বিজ্ঞানীদের ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
চীন ২০২৫ সালে Tianwen-2 মিশন আরম্ভ করবে, যার লক্ষ্য Kamoʻoalewa এর পৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসা। চাঁদের দূরবর্তী দিক থেকে সংগৃহীত নমুনা, চাঁদের সবচেয়ে কম আলোচিত একটি অংশ সম্পর্কে গভীরভাবে জানার পথ খুলে দেবে।
গ্রহাণুটির পৃষ্ঠতলের গঠন সম্পর্কেও জানতেও এটি সাহায্য করবে। আশা করা হচ্ছে বিজ্ঞানীরা এই নমুনা দ্বারা কীভাবে মহাজাগতিক বিকিরণ সময়ের সাথে সাথে একটি গ্রহাণুকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত করে তা জানতে পারবে।
প্যাট্রিক মিশেল বলেন,
“এটি আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এক সৌরজগতে বাস করি। সৌরজগতের রোমাঞ্চকর এক কোণায় আমাদের অবস্থান। এমন কোনো গ্রহ নেই যেটির কাছে আমাদের চাঁদের মত উপগ্রহ রয়েছে। এই বিষয়টি আমাদের জানিয়ে দেয় পৃথিবী এবং চাঁদের সম্পর্কটা কতটা অসাধারণ।”
মোহাম্মদ রিফাতুল ইসলাম মারুফ / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: স্পেস.কম, ফিজিক্স.অর্গ, উইকিপিডিয়া