বিরাট এই মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র এক গ্রহ পৃথিবী। যেখানে ঘটেছে প্রাণের সঞ্চার। এই গ্রহের প্রতিটি বিষয় এমনভাবে গঠিত যা জীবের বিকাশ, জীবনযাপন, চলাফেরা সহ সকল জৈবিক ক্রিয়া-কলাপের জন্য আদর্শ। সম্প্রতি নিখুঁতভাবে পৃথিবীর ঘূর্ণনগতি পরিমাপের যন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন জার্মানির গবেষকেরা।
পৃথিবীর পরিবেশ জীবের বসবাস উপযোগী গড়ে তোলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এর আহ্নিক গতি। এই আহ্নিক গতির ফলে পৃথিবীতে দিন এবং রাত হয়। সূর্য এবং চাঁদের সাপেক্ষে অবস্থান পরিবর্তন হয়। পৃথিবীতে থাকা পরিবেশ এবং আবহাওয়ার উপরেও এই আহ্নিক গতির প্রভাব রয়েছে। পৃথিবীর এই ঘূর্ণন গতি সবসময় একই নয়। আপাত দৃষ্টিতে দিনার রাতের দৈর্ঘ্য সব সময় একই মনে হলেও অতি সামান্য সময়ের তারতম্য প্রতিনিয়তই হচ্ছে। হতে পারে তা কয়েক মিনিট বা সেকেন্ড। পৃথিবীর ঘূর্ণনের এই সামান্য তারতম্য পরিমাপ করা এতদিন ছিল কষ্টসাধ্য।
কিন্তু এই ঘূর্ণনের ভিন্নতা পরিমাপের জন্য যাবতকালের কালের সবচেয়ে নিখুঁত পদ্ধতি তৈরি করেছে জার্মানির ট্যাকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ এর একদল গবেষক। রিং লেজার জাইরোস্কোপ নামের একটি একটি বিশেষ যন্ত্র যার সাহায্যে ঘূর্ণন নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা সম্ভব। জার্মানির ব্যাভারিয়ান বনে অবস্থিত জিওডেটিক অবজারভেটরি ওয়েটজেল-এ প্রয়োজনীয় যন্ত্র তৈরিতে দুই দশকেরও বেশি সময় ব্যয় করার পরে সফলভাবে পরীক্ষা চালানো হয় । তাদের এই রিং লেজার জাইরোস্কোপটি বিজ্ঞানের যে বিশেষ ঘটনা ব্যবহার করে কাজ করে তা হল Sagnac effect (সাগনাক ইফেক্ট)।
Sagnac effect বা Sagnac interference হলো ১৯১৩ সালে করা একটি পরীক্ষা যা ফ্রান্সের বিজ্ঞানি জর্জেস সাগনাক করেছিলেন। সাগনাক ইফেক্ট এর মাধ্যমে দেখানো হয় কিভাবে ঘূর্ণন গতি আলোর দূরত্ব অতিক্রমের সময়কে প্রভাবিত করে। একটি বিশেষ ধরনের সেটআপ করা হয় যেখানে দুটি আলোক রশ্মি একই স্থান থেকে দুটি ভিন্ন দিকে চলাচল করে এবং পরবর্তীতে উভয়েই একই স্থানে মিলিত হয়।
এই সেটআপ এর নাম রিং ইন্টারফেরোমিটার, যেখানে বর্গাকৃতির একটি ফ্রেমের এক কোনা থেকে দুটি ভিন্ন আলোক রশ্মি ফ্রেমের বাহু বরাবর নিক্ষেপ করা হয় এবং রশ্মি দুটো ফ্রেমে প্রতিফলকে প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় আগের স্থানে ফিরে আসে এবং একটি পর্দায় পতিত হয় যা ডিটেক্টর এর কাজ করে।
স্বাভাবিকভাবে আলো ভিন্ন ভিন্ন দিক দিয়ে গেলেও একই পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় বলে দুটো আলোকরশ্মি একই সময়ে ডিটেক্টরে এসে পড়ে। কিন্তু যখন পুরো ব্যবস্থাটিকে ঘোরানো হয় তখন আলোকরশ্মির অতিক্রান্ত দূরত্ব একই থাকা সত্ত্বেও এই পাশের আলোক রশ্মির সাপেক্ষে পোলার অবস্থাটি একই দিকে ঘুরে সেই পাশের আলোকরশ্মি তুলনামূলক পরে এসে ডিরেক্টরে পতিত হয়।
কেননা ঘূর্ণনের ফলে কালো চলাচল করার সময়ই এক পাশের আলোকরশ্মি হতে প্রতিফলন দূরে চলে যেতে থাকে এবং অপর পাশে সম্পূর্ণ এর বিপরীত ঘটনাটি ঘটে অর্থাৎ প্রতিফলক আলোকরশ্মির কাছাকাছি আসতে থাকে। এই ঘটনাকে বলে সাগনাক ইফেক্ট। এই সাগনাক ইফেক্ট ব্যবহার করেই রিং লেজার জাইরোস্কোপটি কাজ করে।
অতি সামান্য পরিমাণ ঘূর্ণনের ফলে সাগনাক ইফেক্টে আলোকরশ্মীর পতিত হওয়ার সময় ভিন্নতা দেখা যায় ডিটেক্টরে ধরা পড়ে। ঘূর্ণনগতি যত বেশি হবে সাগনাক ইফেক্ট ততটা স্পষ্ট ভাবে দেখা দিবে। ঘূর্ণন বেশি হলে দুটি আলোকরশ্মি পতিত হওয়ার সময়ের পার্থক্য আরো বেড়ে যায়। তাই পুরো ব্যবস্থাটি কতটুকু বেশি গতিতে ঘুরছে তা সহজেই পরিমাপ করা যাবে।
এই রিং লেজার জাইরোস্কোপের যেই অংশ দিয়ে আলো চলাচল করে তাকে বলা হয় Resonator (অনুনাদক)। এই অংশটি হিলিয়াম এবং নিয়ন গ্যাস দিয়ে পূর্ণ থাকে। পৃথিবী যখন ঘুরতে থাকে তখন রিং লেজার জাইরোস্কোপটি স্থির অবস্থায় রাখা হয়। কিন্তু পৃথিবীতে থাকা অন্য সকল বস্তুর মত রিং লেজার জাইরোস্কোপটিও পৃথিবীর সাথে ঘূর্ণনায়মান। তাই রিং লেজার জাইরোস্কোপটি আপাত দৃষ্টিতে স্থির থাকলেও পৃথিবীতে থাকা মানেই হচ্ছে এখানে সাগনাক ইফেক্ট কাজ করবে।
এই ব্যবস্থাটিকে একটি উচ্চ চাপযুক্ত কন্টেইনারের ভেতর করা হয় আশেপাশের থাকা চাপ এবং তাপমাত্রার প্রভাব ঠেকানো যায়। গত চার বছর ধরে গবেষকরা এই ব্যবস্থাটিকে আরো নির্ভুলভাবে ব্যবহারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এই লেজার সিস্টেমের আগে পৃথিবীর ঘূর্ণনে যে গতির ভিন্নতা তা মহাকাশে থাকা নক্ষত্র কিংবা উপগ্রহের সাপেক্ষে পৃথিবীর অবস্থান হিসেব করে বের করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই তা ছিল কঠিন।
পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির এই ভিন্নতা পরিমাপের মাধ্যমে পরিবেশের উপর নানান ধরনের গবেষণা চালানো যায়। এমনকি এল নিনো এর ঘটনা পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বাভাস দেয়ার কাজে এই ঘূর্ণন গতির ভিন্নতা পরিমাণ করা ব্যবস্থা কাজে লাগতে পারে। ‘এল নিনো’ একটি উষ্ণ সামুদ্রিক স্রোত। গ্রীষ্মপ্রধান পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যখন সাধারণ গড় তাপমাত্রা থেকে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায় সেই অবস্থাকেই বলা হয় ‘এল নিনো’।
একাংশ বিশেষজ্ঞের মতে ‘এল নিনো’-এর প্রভাবে ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। যেহেতু পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সাথে এর বায়ুমণ্ডলও ঘূর্ণায়মান তাই ঘূর্ণনে সামান্য ভিন্নতাও আবহাওয়ার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। তাই ঘূর্ণনকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাশাপাশি আবহাওয়া ও পরিবেশ নিয়েও কাজ করতে পারবেন।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্সনিউজ, ফিজিক্স.অর্গ, ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং