আমাদের সমাজে যখন কোনো ব্যক্তি সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন আমরা প্রায়ই তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে থাকি, “চিন্তা করবেন না, সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে”। তবে এই একই আশ্বাসটুকু চিকিৎসকরা অনেক রোগীর পরিবারকে দিতে সক্ষম হন না। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানে এখনও অনেক বিরল জেনেটিক রোগের সমাধান দেয়া সম্ভব হয়নি। তবুও কিছু চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের এক-একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে বাঁচানোর অদম্য ইচ্ছা অনেক চমৎকার ঘটনা ঘটিয়ে দেয়। ঠিক এমনই এক ঘটনা সোবিয়া কুরেশি এবং জাহিদ বশির এর এনজাইম ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ১৬ মাস বয়সী একমাত্র কন্যা সন্তান আইলার ক্ষেত্রে ঘটেছে। মূলত ২ সন্তান মারা যাবার পর একই পম্পে রোগ-এ আক্রান্ত ৩য় শিশুর ভ্রূণে এনজাইম থেরাপি প্রয়োগ করে এই প্রায় দুঃসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করা হয়।
প্রথমবারের মতো, চিকিৎসকরা সফলভাবে ‘Umbilical cord’ এর মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম ফিটাসের (আইলার) দেহে প্রবেশ করিয়ে তাকে ‘Infantile Pompe Disease‘ এর মারাত্মক প্রভাব থেকে বাঁচাতে সক্ষন হন। বর্তমানে ১৬ মাস বয়সী আইলা স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হচ্ছে। আইলার এই সুস্থতার পিছনে তিনটি মেডিকেল সেন্টারের উৎসাহী গবেষক এবং আইলার পরিবারের দুর্দশা দেখে প্রভাবিত হওয়া চিকিৎসকদের প্রচেষ্টার গল্প যেকোনো গল্পকে হার মানাতে সক্ষম।
তাহলে কী ছিলো আইলার এর আজকের সুস্থতার পিছনের ঘটনাটি? চলুন শুরু থেকে জেনে নেয়া যাক।
২০০৮ সালে পাকিস্তানে সোবিয়া কুরেশি এবং জাহিদ বশিরের পারিবারিকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ২০১০ সালে মিসেস কুরেশির গর্ভে প্রথম সন্তান আসে, তখন আগত নবজাতকের কী হতে চলেছে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেন নি। ২০১১ সালে, তাদের প্রথম সন্তান জারা, জেনেটিক ডিসঅর্ডার, ‘Pompe disease’ নিয়ে জন্মলাভ করে। তখন এই দম্পতিকে ‘Children Hospital of Eastern Ontario‘ এর শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর চক্রবর্তীর কাছে পাঠানো হয় এবং তিনি জারাকে ‘Enzyme treatment’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
‘Pompe Disease’ বা এই জটিল জেনেটিক পম্পে রোগ-এ আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে Acid alpha glucosidase (GAA) এনজাইম অনুপস্থিত থাকে। সাধারণত দেহে শক্তি উৎপন্নের জন্য সঞ্চিত গ্লাইকোজেন ভাঙতে GAA এনজাইম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই রোগে জিনের মধ্যে মিউটেশন ঘটে GAA এনজাইমের পরিমাণ কমিয়ে দেয় বা একেবারে নির্মূল করে দেয়। ফলে দেহে অতিরিক্ত গ্লাইকোজেন জমতে থাকে। গ্লাইকোজেন না ভাঙায় দেহে শক্তিও উৎপন্ন হয় না। এক পর্যায়ে, হৃৎপিন্ড ও অন্যান্য পেশি দূর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগী অতিদ্রুত মৃত্যুবরণ করে।
যেভাবে প্রথম এই এনজাইম ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয় ও তার ফলাফল:
Enzyme treatment এ শিশুদের দেহে অনুপস্থিত Acid alpha glucosidase এনজাইম প্রতি দুই সপ্তাহে প্রবেশ করানো হয়। একইসাথে শিশুর দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দমন করে রাখার জন্য ওষুধ প্রয়োগ করা হয় যাতে এনজাইমের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি না হয়। ডক্টর চক্রবর্তী শিশু জারা এর চিকিৎসা দ্রুত শুরু করতে চান। যেদিন শিশুটির চিকিৎসা শুরু হবে, সেইদিন শিশু জারা এর ফুসফুস সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং ১০ দিন বাচ্চাটিকে ভেন্টিলেটর এ রাখা হয়।
পরবর্তীতে ১ মাস জারা কে ইউনিট এ কাটাতে হয়। এই ১ মাসে শিশুটি তার পা নাড়ানো এবং খাদ্য গলাধঃকরণের শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত টিউবের মাধ্যমে তাকে খাওয়াতে হয়। সাড়ে ৬ মাস বয়সে জারার এনজাইম ট্রিটমেন্ট শুরু হলেও তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এভাবেই যখন জারা ২ বছর বয়সে পা দেয়, তখন তার চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় তার মা-বাবা। এর ৫ মাস পরেই বাড়িতে জারা না ফেরার দেশে চলে যায়।
তারপর ২০১৬ সালে, মিসেস কুরেশি আরেকবার মা হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। কিন্তু এবারও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হতে হয় তাকে। দ্বিতীয় সন্তানও একই পম্পে রোগ নিয়ে জন্মলাভ করে। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, নতুন নবজাতক সারা কে কোনো এনজাইম ট্রিটমেন্ট করাবেন না এবং শুধুমাত্র ব্যাথা উপশমকারী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বলেন। এভাবেই তাদের দ্বিতীয় সন্তান আট মাসের মাথায় পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।
২০২০ সালের প্রথমদিকে, ডক্টর চক্রবর্তী ফোনালাপের মাধ্যমে জানতে পারেন মিস কোরেশি পুনরায় মা হতে চলেছেন এবং এবারের প্যারেন্টাল টেস্ট প্রমাণ করে যে, তার গর্ভে থাকা সন্তান এবারও পম্পে রোগ নিয়ে বেড়ে উঠছে। কিন্তু এবার এই দম্পতি ফিটাসটির চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ভাবেন হয়তো এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা পদ্ধতি কিছুটা উন্নত হয়েছে এবং জন্মলাভের পর যদি শিশুকে বাঁচানো সম্ভব নাও হয় তবুও বাচ্চার কষ্ট তো লাঘব হবে।কীভাবে এলো এই এনজাইম ট্রিটমেন্ট?
ডক্টর প্রিয়া কৃষ্ণানী ১৯৯১ সালে Medical Trainee থাকাবস্থায় ‘Lysomal storage disease‘ থেকে রক্ষা করার একটি উপায় খুঁজে বের করেন। রোগটির একটি মৃদু রূপ রয়েছে যাতে শেষ পর্যন্ত রোগীর হৃৎপিন্ড ও অন্যান্য পেশী দূর্বল না হওয়া পর্যন্ত কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায় না। যতদিনে লক্ষণ প্রকাশ পায় ততদিনে রোগীকে প্রতিনিয়ত Enzyme treatment দিয়েও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। অতঃপর সে ও তার সহকর্মীরা মিলে এই রোগের চিকিৎসার গবেষণায় নেমে পড়ে এবং প্রায় এক দশক পর, তারা এই রোগে জন্ম নেয়া শিশুদের দেহে যে এনজাইম অনুপস্থিত থাকে তা শরীরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাদের প্রথম চেষ্টায় তিনজন শিশুর মধ্যে দুইজনই মারা যায়।
এর পিছনের মূল কারণ হলো মূলত শিশুগুলোর দেহে কোনো এনজাইম তৈরি হতো না। তাই ইনজেকশনের মাধ্যমে এনজাইম প্রবেশ করানো হলে এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে তা বিনষ্ট করে দেয়। যদি তারা কোনোভাবে বাচ্চাগুলোর ইমিউন সিস্টেমকে দমিয়ে রাখতো, তাহলে এনজাইম হয়তো এর কাজ সম্পন্ন করতে পারতো। এই ধারণাকে কাজে লাগিয়েই তিনি সামনে আরো পরীক্ষা চালান এবং সফলতা লাভ করেন। ৭০ জন শিশুকে এই সফল চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে তিনি আত্মবিশ্বাস লাভ করেন। চিকিৎসাপ্রাপ্ত শিশুগুলো এখনো জীবিত এবং সুস্থ, কিন্তু যে সমস্যাটি রয়ে যায় প্রতিক্ষেত্রে তা হলো পেশি দূর্বলতা। এখানে তিনি ভ্রূণে এনজাইম থেরাপি প্রয়োগ নিয়ে কাজ করেছিলেন।
ডক্টর চক্রবর্তী যখন ডক্টর কৃষ্ণানী কে মিস কুরেশি সর্বশেষ গর্ভাবস্থার কথা জানান, তখন ডক্টর কৃষ্ণাণী ‘Infantile Pompe’ প্রতিরোধ করা যেতে পারে বলে আশ্বাস দেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গর্ভে বিকাশরত সন্তান জন্মলাভের পূর্বেই তার ভ্রূণে এনজাইম থেরাপি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু ফিটাসটি তখনো অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম ছিলো না, তাই ইমিউন সিস্টেম দমনের ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন পড়েনি। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, শিশু জন্মলাভের পর প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হবে এবং বাচ্চার যখন এনজাইম সহনীয় হবে তখন এই ওষুধের প্রয়োগ বন্ধ করা হবে।
মূলত অ্যাম্বিলিকাল কর্ডের মাধ্যমে ২৪-৩৬ সপ্তাহে ফিটাসের দেহে ৬ বার এনজাইম প্রবেশ করানো হয়। ফলাফল হিসেবে, গর্ভে থাকা ফিটাসের এর স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি হচ্ছিলো। তার হৃৎপেশি ঠিক ছিলো এবং শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক ছিলো। ২২ শে জুন, ২০২১ এ আইলা সুস্থ স্বাভাবিক নবজাতক হিসেবে জন্ম নেয়, বর্তমানেও সে একজন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক শিশু হিসেবেই বিকাশ লাভ করছে।