মাতৃত্বের সংজ্ঞায়নে বলা যায়, একটি নতুন জীবনকে নিজের মধ্যে ধারণ ও পরিস্ফুটনের মাধ্যমে ধরণীতে আগমনের প্রক্রিয়া। ‘নিরাপদ মাতৃত্ব‘ হলো গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন সময়ে সমস্ত নারীদের নিরাপদ এবং সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় যত্ন ও সুবিধা নিশ্চিতকরণ। ‘মাতৃত্ব’ ব্যাপারটি একজন নারী, তার পরিবার এবং সম্প্রদায়ের জন্য প্রত্যাশার এবং আনন্দের। আজ ২৮শে মে, নিরাপদ মাতৃত্বে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে ‘সায়েন্স বী’ পরিবারের ছোট্ট একটি আয়োজন।
নিরাপদ মাতৃত্ব ও বাংলাদেশঃ
বর্তমানে বাংলাদেশে ‘মাতৃত্ব’ ব্যাপারটি শুধুমাত্র নারীদের গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন সময়ে অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার এই দুই জায়গাতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং নিরাপদ মাতৃত্ব নারীর মৌলিক মানবাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি উদ্যোগ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার অনুচ্ছেদ ২৫ অনুযায়ী একজন নারী খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, যত্ন এবং প্রয়োজনীয় সামাজিক পরিষেবা সহ মাতৃত্বকালীন পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বিশেষ যত্ন এবং সহায়তা পাওয়ার অধিকারী।
এটি থেকে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো থেকে আসে, ২০১১ সালে হোয়াইট রিবন অ্যালায়েন্স একটি সার্বজনীন মানবাধিকার হিসাবে সম্মানজনক মাতৃত্ব যত্নের প্রচারের জন্য সন্তান জন্মদানকারী মহিলাদের অধিকারের জন্য একটি সনদ চালু করেছিল। বাংলাদেশ সেই দেশগুলির মধ্যে একটি যারা আন্তর্জাতিক কনভেনশনগুলোকে অনুমোদন করেছে যার ভিত্তিতে এই সনদ তৈরি হয়েছে।
এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে গর্ভাবস্থায় সর্বত্র মহিলাদের প্রয়োজনীয় এবং জীবন রক্ষাকারী স্বাস্থ্যসেবা গুলো সম্পর্কে তাদের সচেতনতা রয়েছে, তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি। বিগত ১৫ বছরে, বাংলাদেশে মহিলাদের স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার ব্যবহার স্থিরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে গর্ভাবস্থা এবং প্রসব সংক্রান্ত যত্নের জন্য। অর্ধেকেরও বেশি মহিলা এখন তাদের প্রসবের জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান, বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিং হোমে।
তবুও, ক্ষেত্রবিশেষে মহিলাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও সাশ্রয়ী মূল্যের এবং মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের অভাবে যথাযথ স্বাস্থ্য সুবিধায় পৌঁছাতে অক্ষম। যোগাযোগের পথ সহজ না হওয়ায় এখনোও প্রত্যন্ত এবং দুর্গম অঞ্চলের মহিলারা তাদের সমস্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং প্রয়োজনের জন্য বঞ্চিত থাকে। শহুরে এলাকায় উপলব্ধ স্বাস্থ্য পরিষেবার উচ্চ মূল্য এবং নিম্ন মানের কারণে অনেক শহুরে এলাকায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের জন্য এটি অনেকক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।
গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের সময় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মহিলাদের অভিজ্ঞতা স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোর প্রতি তাদের আস্থা তৈরি করতে অথবা ভেঙেও দিতে পারে। একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা তাদের আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলবে আবার একটি নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে নিজেদের, তাদের পরিবার এবং সমবয়সীদের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া সম্পর্কে ভয় এবং শঙ্কা তৈরি করবে।
বাংলাদেশে মাতৃকালীন উন্নত পরিচর্যা আনায়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা পরিবেশে আরোও পরিবর্তন আনা জরুরি। বেশিরভাগ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা মহিলাদের ক্লিনিক্যাল দিকগুলিতে বেশি ফোকাস করে। তবে এর পাশাপাশি,
নারী এবং তার সন্তানের প্রতি সম্মান, অবহিত সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ, সমস্ত স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবার কেন্দ্রে থাকা উচিত।
মহিলার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার এবং সমস্ত তথ্য খোঁজার অধিকারকে সম্মান করা উচিৎ যা তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।
ক্লিনিক্যাল পদ্ধতির জন্য সম্মতি দেওয়া বা প্রত্যাখ্যান করা, মাতৃত্বকালীন পরিচর্যার সময় সঙ্গী থাকা বা স্বাভাবিক ডেলিভারি বেছে নেওয়ার জন্য তার পছন্দ এবং অপছন্দগুলোকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ।
অনেক বেশি ভিড় এবং কম স্টাফযুক্ত হাসপাতালে, স্বাস্থ্যসেবা চাওয়া মহিলাদের জন্য পর্যাপ্ত গোপনীয়তা নিশ্চিত করা ক্ষেত্রবিশেষে চ্যালেঞ্জিং হয়ে পরে। গোপনীয়তার অনুপস্থিতি এবং মহিলা নার্সদের অনুপলব্ধতা অনেক সময় গর্ভবতী মহিলাদের জন্য হাসপাতালে যেতে একটি গুরুতর বাধা হতে পারে।
নারীদের মর্যাদা ও সম্মানের সাথে আচরণ করার এবং ক্ষতি ও দুর্ব্যবহার থেকে মুক্ত থাকার অধিকার রয়েছে। প্রায়শই, যত্ন নেওয়া মহিলাদের খাবার বা জলের অপ্রতুলতার কারণে দীর্ঘ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। যদিও স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোতে শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায় না, তবুও অ-সম্মতিমূলক যত্ন এবং অবহেলার ঘটনাও কিন্ত অস্বাভাবিক নয় এবং এ ধরনের ঘটনাগুলো সমানভাবে অসম্মানজনক।
স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোতে গোপনীয়তা লঙ্ঘন, ভর্তির প্রত্যাখ্যান, সন্তান প্রসবের সময় অবহেলা এসকল অনিয়ম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ।
ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি যেমন: সিজারিয়ান সেকশন ডেলিভারি, পেশাদার সমিতি এবং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের উপর নজরদারি করা অনিয়ম রুখতে কাজ করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
কুসংস্কারঃ
এছাড়াও মাতৃত্ব নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারগুলো যেমন: বাচ্চা প্রসব কালীন সময়ে স্তনবৃন্তের উদ্দীপনা, ক্যাস্টর অয়েল পান, হাঁটা, সম্মোহন, যৌন মিলন বা মশলাদার খাবার খাওয়ার মাধ্যমে সহজে প্রসব বেদনা সৃষ্টি হয়, বাচ্চার ওজন কম হলে জন্ম দেওয়া সহজ হয়, প্রসবের ঠিক আগে বাচ্চারা নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়, এপিডুরাল থাকলে সিজারিয়ান হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এ ধরনের প্রচলিত কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে যথেষ্ট প্রচারণারও প্রয়োজন রয়েছে।
এছাড়াও বিগত বছরগুলোতে কোভিড-১৯ এর সময় বাংলাদেশ নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণ ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মহামারীর সেই সময়টাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিবর্তন, ভ্রমণে বিধিনিষেধ, অর্থনৈতিক কষ্ট, এবং হাসপাতালগুলো থেকে সংক্রামিত হওয়ার ভয় অনেক মাকে গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সময়কালে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেবা চাইতেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
তবে এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক হলো শত শত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ডাক্তার, নার্স ও কর্মরত স্টাফদের সাহস এবং সংকল্প। এই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস উপলক্ষে, যারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশী মায়েদের সাথে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেই সকল চ্যাম্পিয়নদের ‘সায়েন্স বী’ এর পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সর্বোপরি অর্থনৈতিক অবস্থা, বৈবাহিক অবস্থা, ধর্ম, জাতি, ভাষা বা অন্য যেকোনো কারণের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য ছাড়াই গর্ভাবস্থা এবং প্রসবকালীন সময়ে সকল নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যেতে হবে। আমরা আশা করছি বাংলাদেশ নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করণে লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে খুব দ্রুতই উন্নয়ন আনয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাবে।