নিকট আত্মীয়ের থেকে রক্ত গ্রহণকে না বলি প্রাণঘাতী Graft Versus Host Disease থেকে মুক্তি পাই!
দুর্ঘটনায় আহত, ক্যান্সার বা অন্য কোন জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য, অস্ত্রোপচার কিংবা সন্তান প্রসব অথবা থ্যালাসেমিয়ার মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। পরিসংখ্যান অনুসারে মাত্র ৩০% রক্ত আসে স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে, ১০% আসে পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে এবং বাকি ৬০% আসে নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে। যেহেতু এখনো বেশিরভাগ মানুষ রক্তের জন্য নির্ভর করেন নিকট আত্মীয়ের ওপর সেহেতু কে কাকে রক্ত দিতে পারবে সে সম্পর্কেও আমাদের একটা প্রাথমিক জ্ঞান থাকা জরুরি।
কিন্তু রক্ত দেবার ক্ষেত্রে ডোনার যদি নিকটাত্মীয় বা ফাস্ট ডিগ্রী হন তাহলে Graft Versus Host Disease (GVHD) নামক এক বিরল ও প্রাণঘাতী রোগের দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রোগটি কতটা ভয়াবহ সেটা ভালোভাবে অনুধাবন করতে ইমিউনো সিস্টেম কিভাবে কাজ করে সেটা আগে বুঝতে হবে।
ইমিউনো সিস্টেম যেভাবে কাজ করে-
আমাদের ইমিউনো সিস্টেম এতটাই সুগঠিত যে আমাদের দেহ একবার কোন রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে রক্তে অবস্থিত স্মৃতিকোষ জীবাণুগুলোকে চিনে রাখে এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ কারণে একবার কারো হাম হলে পরে হাম সৃষ্টিকারী জীবাণু আবার দেহে প্রবেশ করলে স্মৃতিকোষের নির্দেশে নির্দিষ্ট কোষ সমবেত হয়ে হামের জীবাণু ধ্বংস ও নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
সব কোষঝিল্লিতেই প্রোটিন থাকে। অ্যান্টিজেন হলো ফরেন প্রোটিন বা নন-সেল্ফ প্রোটিন। আর অ্যান্টিজেনকে ধ্বংস করার জন্য পাঁচ রকমের প্রোটিন আমাদের শরীরে তৈরি হয়ে থাকে যাদেরকে ইমিউনোগ্লোবিউলিনস বা এক কথায় অ্যান্টিবডি বলা হয়। দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় স্মৃতিকোষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এগুলো অ্যান্টিজেনকে চিহ্নিত ও মোকাবিলা করে। স্মৃতিকোষ হচ্ছে লিম্ফোসাইট নামক অদানাদার শ্বেত রক্তকণিকা। লিম্ফোসাইট দুই ধরনের (T-লিম্ফোসাইট ও B-লিম্ফোসাইট)। T-লিম্ফোসাইট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে এবং জীবাণুকে সরাসরি আক্রমণ করে । অন্যদিকে B-লিম্ফোসাইট আন্টি অ্যান্টিবডি উৎপন্ন যা জীবাণুকে নিষ্ক্রিয় করে বা ধ্বংস করে।
Graft Versus Host Disease-
GVHD বিকশিত হয় যখন কোন রোগীর দেহের রক্ত কণিকার উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করতে বা রক্তের ঘাটতি পূরণ করতে দাতার কাছ থেকে স্টেম সেল বা অস্থিমজ্জা গ্রহণ করা হয় তখন দাতার শ্বেত রক্তকণিকা (টি-কোষ) হোস্ট কোষগুলিকে নন-সেল্ফ প্রোটিন হিসাবে চিহ্নিত করে আক্রমন করতে শুরু করে ৷ কাজেই বুঝতেই পারছেন যে কোন ধরনের ট্রান্সপ্লান্টের সময় সর্বোত্তম ম্যাচিং বা উপযুক্ত ডোনার খুঁজে বের করা কতটা জরুরি।
আর ঠিক এই কাজটাই করা হয়ে থাকে HLA (Human Leukocyte Antigens) টেস্টের মাধ্যমে। যার HLA যত বেশি তার গ্রহণযোগ্যতা তত বেশি। নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে রক্ত নেয়ার ফলে Graft Versus Host Disease সম্ভাবনা বেড়ে যায় সর্বোত্তম ম্যাচিংয়ের অভাবে। প্রতি ১০ বারের ভিতর মাত্র ৩ বার নিজের পরিবারের ভিতর পারফেক্ট ম্যাচিং খুঁজে পাওয়া যায়।
Graft Versus Host Disease এর লক্ষণ-
GVHD ২ ধরনের।
-
Acute GVHD
-
Chronic GVHD
Acute GVHD র লক্ষণগুলি সাধারণত ট্রান্সপ্ল্যান্টের ৬ মাসের মধ্যে প্রকাশ পায়। ইমিউন সিস্টেম, ত্বক, লিভার এবং অন্ত্র প্রধানত প্রভাবিত হয়ে থাকে।
Acute GVHD র লক্ষণ
-
পেটে ব্যথা বা ক্র্যাম্প, বমি বমি ভাব, বমি এবং ডায়রিয়া
-
জন্ডিস (ত্বকের বা চোখের হলুদ রঙ) বা লিভারের অন্যান্য সমস্যা
-
ত্বকে ফুসকুড়ি, চুলকানি, ত্বকে লালচে ভাব
Chronic GVHD সাধারণত ট্রান্সপ্ল্যান্টের ৩ মাসেরও বেশি সময় পরে আত্মপ্রকাশ করে এবং সারাজীবন স্থায়ী হতে পারে।
Chronic GVHD র লক্ষণ
-
শুষ্ক চোখ, জ্বলন্ত সংবেদন
-
শুষ্ক মুখ, মুখের ভিতরে সাদা দাগ এবং মশলাদার খাবারের প্রতি সংবেদনশীলতা
-
ক্লান্তি, পেশী দুর্বলতা এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা
-
জয়েন্টে ব্যথা
-
শ্বাসকষ্ট
-
যোনি শুষ্কতা
-
ওজন হ্রাস
-
যকৃত থেকে পিত্ত প্রবাহ হ্রাস
-
ভঙ্গুর চুল এবং অকালে চুল পাকা
-
সাইটোপেনিয়া (পরিপক্ক রক্ত কোষের সংখ্যা হ্রাস)
-
পেরিকার্ডাইটিস (হৃদপিণ্ডের চারপাশের ঝিল্লিতে ফুলে গিয়ে বুকে ব্যথার উদ্দিপনা সৃষ্টি)
কে কাকে রক্ত দিতে পারবে?
আমরা কমবেশি সবাই জানি যে ১৮-৪৫ বছর বয়সের মধ্যে শারীরিকভাবে সুস্থ নারী ও পুরুষ ৩ মাস পর পর রক্ত দিতে পারেন।রক্তদাতাকে অবশ্যই ভাইরাসজনিত রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ এবং চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে। রক্তের গ্রুপ মোট ৮ ধরণের। তন্মধ্যে O কে সর্বজনীন দাতা এবং AB-কে সর্বজনীন গ্রহীতা বলা হয়৷
কখনো কি ভেবে দেখেছি, একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় ঠিক কতজন মানুষকে রক্ত দানের মাধ্যমে বাঁচানোর ক্ষমতা রাখেন? জেমস হ্যারিসন নামের এক অস্ট্রেলিয়ান ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে নিজের রক্ত ও রক্তের উপাদান প্লাজমা দানের মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ শিশুর প্রাণ বাঁচিয়ে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নিজের এক অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছেন। তিনি সর্বমোট ১১৭৩ বার রক্ত প্রদানের মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন করেছেন।
রক্ত দেয়ার পর কিছুটা মাথা ঘোরানো অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। ওই সময় হাঁটাহাঁটি না করে অন্তত ১-২ ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে পারেন।রক্ত দেয়ার পর লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে অন্তত ১-১.৫ মাস সময় লাগে। রক্ত দেয়ার সময় শরীর থেকে রক্তের পাশাপাশি ২৫০-৩০০ মিলিগ্রাম আয়রন কমে যায় এই ক্ষয়পূরণে আয়রন ও প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন ডাক্তারেরা।
রক্ত দেয়ার উপকারিতা:
নিয়মিত রক্ত দেয়ার কিছু উপকারিতা রয়েছে। সেগুলো হলো:
১. এতে একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব।
২. নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
৩. বছরে তিনবার রক্ত দিলে শরীরে নতুন লোহিত কণিকা তৈরির হার বেড়ে যায়। এতে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। দ্রুত রক্ত স্বল্পতা পূরণ হয়।
৪. রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়, এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
৫. রক্ত দিলে যে ক্যালোরি খরচ হয়, তা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৬. শরীরে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি বা এইডসের মতো বড় কোন রোগ আছে কি না, সেটি বিনা খরচে জানা যায়।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
৮. রক্তদাতার যদি নিজের কখনো রক্তের প্রয়োজন হয় তাহলে ব্লাড ব্যাংকগুলো তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বের ৯ কোটি ২০ লাখ মানুষ রক্ত দিয়ে থাকে। মূলত যারা মানুষের জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করেন তাদের দানের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি দিতে সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছরের ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালন করা হয়।
চিকিৎসা-
ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরেও GVHD এর সম্ভাবনা কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে যেতে হয়। নিরীক্ষণের স্বার্থে আপনার চিকিৎসক নিয়মিত ভিত্তিতে বিভিন্ন ল্যাব এবং ইমেজিং পরীক্ষা দিতে পারেন। তাছাড়া GVHD র যেকোনো লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসকের সরনাপন্ন হন।
মোঃ গালীব হাসান/নিজস্ব প্রতিবেদক
সোর্স: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/
https://www.bbc.com/bengali/
https://blog.sciencebee.com.