মানুষ সামাজিক ভাবে একে অন্যের সাথে মেশার মাধ্যমে টিকে থাকে। তবুও, লকডাউন ও সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং এর বেড়াজালে আশেপাশে বেড়েছে নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা একাকীত্ব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতা, আয়ুতে খারাপ প্রভাব রাখে।
নিঃসঙ্গতা অনুভব করা লোকদের মস্তিষ্কের চিত্রগুলি নির্দিষ্ট স্নায়বিক অঞ্চলে পৃথক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। ধারণা করা হচ্ছে, যারা একাকী বোধ করেন তারা বিভিন্ন ঘটনা (অতীত বা ভবিষ্যতের) কল্পনা করে নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখেন।
কানাডার মন্ট্রিয়াল নিউরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট (Montreal Neurological Institute) হাসপাতালের গবেষকদের এক নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, নিঃসঙ্গ মানুষদের মস্তিস্কে ‘ডিফল্ট নেটওয়ার্ক’ (default network) নামক অঞ্চলের নির্দিষ্ট চিত্র বা ম্যাপিং প্রদর্শন করে। সমীক্ষাটির ফলাফল নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই নেটওয়ার্কটি চিন্তা করার প্রক্রিয়াগুলির সাথে সম্পর্কিত। কোনো কিছু স্মরণে রাখতে, কল্পনা করতে এবং কোনো কিছু (বিশেষত কোনো পূর্বনির্ধারিত কাজ) সময় মতো পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন করার ক্ষমতা রয়েছে এই নেটওয়ার্কের।
এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর ব্যাক্তির সংখ্যা প্রায় ৪০,০০০। অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ছিলো ৫৪.৯ বছর। জেনেটিক এবং লাইফস্টাইলের সাথে একাকীত্বের বিষয়ে প্রশ্নাবলীর মাধ্যমে গবেষকরা তাদের গবেষণার জন্য প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।
প্রশ্নাবলী ছাড়াও, গবেষকরা গ্রে ম্যাটার (gray matter), হোয়াইট ম্যাটার (white matter) এবং ক্রিয়ামূলক সংযোগের বৈশিষ্ট্যগুলি পরীক্ষা করতে ইউ.কে. বায়োব্যাঙ্ক (UK Biobank) থেকে এমআরআই ব্রেন স্ক্যানও সংগ্রহ করেছিলেন।
গ্রে ম্যাটার পেশী নিয়ন্ত্রণে জড়িত। পাশাপাশি কোনো কিছুর প্রতি সংবেদনশীল হওয়া ও উপলব্ধি করা, স্মৃতি, আবেগ, বক্তৃতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের মত কাজগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। হোয়াইট ম্যাটার মস্তিষ্ক থেকে শরীরের অন্যান্য অঞ্চলে তথ্য ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে।
নিঃসঙ্গ মানুষের ডিফল্ট নেটওয়ার্কগুলি একসাথে শক্তিশালী অবস্থায় ছিল এবং অপ্রত্যাশিতভাবে এখানে গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ বেশি ছিল। গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে, নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক এমন আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেছিল, যা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন না এমন ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিল না। এছাড়াও, তাদের ডিফল্ট নেটওয়ার্কটির মস্তিষ্কের অন্যান্য অঞ্চলগুলিতে আরও শক্তিশালী সংযোগ ছিল। এই নিদর্শনগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, “নিঃসঙ্গ মস্তিষ্ক” এবং “নিঃসঙ্গ না” এমন ভিত্তিতে মস্তিষ্কের মধ্যে পার্থক্য হতে পারে।
ডিফল্ট নেটওয়ার্কের নিদর্শনগুলি মস্তিষ্ক এবং আচরণের মধ্যে সম্পর্ক বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
মানুষের মস্তিষ্কের এই ক্ষেত্রটি সক্রিয় হয় যখন কেউ অতীতের স্মৃতিগুলো স্মরণ করে বা ভবিষ্যতের পরিস্থিতিগুলির বিষয়ে কল্পনা করে। এটি একটি নির্দেশক যে, একাকীত্বের মুখোমুখি হওয়ার সময় লোকেরা কীভাবে চিন্তা করে।
গবেষণাপত্রটির একজন লেখক নাথান স্প্রেং অনুমান করেছেন, নিঃসঙ্গতা একজন মানুষের অন্তর্নিহিত চিন্তাভাবনা গুলোর গতি বাড়িয়ে দেয়, যার ফলস্বরূপ মানসিক প্রক্রিয়াগুলি উত্তেজিত হয়।
গবেষণাপত্রের অন্য এক লেখক ড্যানিলো বজডোক বলেছেন যে, “আমরা এখন কাজ করছি মস্তিষ্কের উপরে নিঃসঙ্গতার প্রভাব নিয়ে। গবেষণার যত গভীরে আমরা যেতে পারব, তত আমরা আমাদের সমাজে একাকিত্ব হ্রাস করার গুরুত্ব আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবো”।
মানুষ একা থাকার মত করে আসলে সৃষ্টি হয়নি। একা থাকা মানসিক ভাবে তো ক্ষতিকরই, শারীরিক ভাবেও একাকিত্ব নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একাকিত্ব উচ্চ রক্তচাপ, আলঝেইমার (স্মৃতি বিভ্রম) থেকে শুরু করে অপরিণত বয়সে মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কায়েস মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ বিগ থিংক, সায়েন্স এলার্ট, ন্যাচার ডট কম, মেডিকেল নিউজ টু-ডে, সায়েন্স ডেইলি
+1
2
+1
3
+1
1
+1
12
+1
3
+1
1
+1
14