প্রথমত আজকের সভ্যতার সৃষ্টির পেছনে নারীর ভূমিকা অনেকটা অস্বীকার করে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেনঃ-
“সাহিত্য কলায় বিজ্ঞানে দর্শনে ধর্মে বিধি ব্যবস্থায় মিলিয়ে আমরা যাকে সভ্যতা বলি সেটা হলো পুরুষের সৃষ্টি“
আবার ভলটেয়ার একই মন্তব্য প্রায় স্বীকার করে একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেনঃ-
“ইতিহাসে জ্ঞানবতী নারী খুজলেই পাওয়া যাবে,
এমনকি নারী যোদ্ধার অস্তিত্বও, কিন্তুু কোথাও নারী উদ্ভাবক পাওয়া যাবে না“
কিন্তুু প্রকৃতপক্ষে কি আপনি তাই মেনে নিবেন?!
কখনোই না। ইতিহাস খুঁজলে নারী উদ্ভাবক তো বটেই প্রকৌশল ও বিজ্ঞানে অসংখ্য নারীর অস্তিত্ব রয়েছে।তাদের জন্মই হয়েছিল মূলত নিজেদেরকে বিজ্ঞানের অবদানে নিবেদন করতে।
সুদূর অতীতে- আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ঠিক এইরকম একজন মহীয়সী নারী বিজ্ঞানী ছিলেন হাইপেশিয়া (hypatia)।
অবাক হচ্ছেন দেড় হাজার বছর পর তাকে নিয়ে আলোচনা করে কি লাভ!
কিন্ত প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের কল্যাণে তার অবদান এতটায় বেশি যে অবাক হয়েই তাকে স্মরণ করতে হয়।চলুন জেনে নিই কেনই বা হাইপেশিয়া কে স্মরণ করব!
জন্মস্থান ও ব্যাক্তিগত জীবনাদর্শঃ-
হাইপেশিয়া ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা থিওন ও ছিলেন বড় দার্শনিক। ইতিহাসে যোদ্ধার ঘর থেকে যোদ্ধা হতে শুনেছেন কিন্ত দার্শনিক এর ঘরে নারী বিজ্ঞানী জন্ম নিয়েছেন নজির এ খুব কমই আছে।সেই যুগে যেখানে নারীদের পুরুষের সম্পত্তি হয়ে থাকতে হত সেখানে অনিন্দ্য সুন্দরি হাইপেশিয়া সদম্ভে পুরুষদের জগতে ঘুরে বেড়াত। তাঁকে বলা হত হত – ‘Le souffle de Platon et le corps d’Aphrodit’- অর্থাৎ, ‘পরমাসুন্দরী আফ্রোদিতির দেহে প্লেটোর আত্মা’ যেন’।
স্বভাবতাই সুদর্শনা আর বিদুষী হাইপেশিয়াকে বিয়ে করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন অনেকেই, বিয়ে করার জন্য পুরুষরা পাগল হয়ে যেত।বর্নিত আছে তার এক ছাত্রই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল কিন্ত সে নারী বিড়ম্বনার একটা নমুনা দেখিয়ে মোহ মুক্ত করেছিলেন। আসলে বিজ্ঞানের কল্যাণে নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করেছেন যে অন্যকোনো আকর্ষণ তাকে মোহ করতে পারে নি।
লক্ষনীয় যে আমাদের সাধারণ দৃষ্টির অগোচরে বিজ্ঞানীদের কতটা ত্যাগ করতে হয় তা নারী হিসেবে দেখিয়ে গেছেন হাইপেশিয়া!
গনিতজ্ঞ হিসেবে হাইপেশিয়ার উত্থান যেমন রোমাঞ্চকর তেমনি মর্মান্তিক তার তিরোধানের ইতিহাস। সম্ভবত: তিনিই ছিলেন গনিতে পর্যাপ্ত অবদান রাখা ইতিহাসের প্রথম নারী গনিতজ্ঞ; মার্গারেট অ্যালিক তাঁর ‘Hypatia’s Heritage’ গ্রন্থে হাইপেশিয়াকে বর্ননা করেন ‘মাদাম কুরীর পূর্ববর্তী সবচাইতে উল্লেখযোগ্য নারী বিজ্ঞানী’ হিসেবে। যে সময়ে মেয়েরা ছিল ভোগ্যপণ্য সেই সময়ে হাইপেশিয়া যে শুধু একজন তুখোড় গণিতবিদ ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন আলেকজেন্দ্রিয়ার আর নিজেকে নিয়োজিত করেন বিজ্ঞানের নিবিড় সাধনায়। বেশ কিছুটা সময় দেশের বাইরেও কাটান তিনি, তারপর দেশে ফিরে এসে গ্রহণ করেন আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিতজ্ঞের পদ।
অচিরেই তিনি নিজেকে পরিণত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে। তিনি পড়াতেন গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন আর মেকানিক্সের বিভিন্ন জটিল জটিল বিষয়গুলো। দূর দূরান্ত থেকে ছাত্ররা শহরে চলে আসতো তার বক্তৃতা শুনতে, আর আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের একটি বিশাল কক্ষে প্রতি সন্ধ্যায় সর্বসাধারণের জন্য হাইপেশিয়া বক্তৃতা দিতেন। তিনি এতটাই যুক্তিসম্মত স্পষ্টভাষী ও সুদক্ষ বক্তা ছিলেন যে তার বক্তব্য শুনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা আসত,রীতিমত টিকেট কিনেও তারা হাইপেশিয়ার বক্তব্য শুনত অধীর আগ্রহে।
>>> আসলে তা না আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির গবেষক কথাটার মনে হয় আলাদা করে একটু ব্যাখ্যা দরকার।এই যে আমরা বিজ্ঞান বিজ্ঞান করছি সেই বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল প্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে আলেকজান্দ্রিয়া কে কেন্দ্র করেই। এইখানেই ইরাতোস্থিনিস পরীক্ষা, হিপার্কাসের নক্ষত্রের সঠিক ব্যাখ্যা, ইউক্লিড এর জ্যামিতি, গেলেনের চিকিৎসা আর শারীরবিদ্যা বই থেকে শুরু করে আলেকজান্দ্রিয়ার গবেষণার অসংখ্য নিদর্শন দেখানো যায়। এমন বিশ্ব বিখ্যাত লাইব্রেরি ও গবেষণাগারের প্রধান গবেষক তবুও একজন নারী হওয়া সত্বেও! ভাবতেই পারছেন।
হাইপেশিয়া মূলত একজন প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসী ছিল।কিন্ত একদল খ্রিস্টান ধর্মান্ধরা তার বিজ্ঞান চর্চা কে ধর্মবিরোধী ভাবত।একজন নারী হয়ে এইরকম সাহসী ও যুক্তিনির্ভর বক্তব্য থামাতে না পেরে হত্যার মত জঘন্য সিদ্ধান্ত নিল।
৪১৭ খ্রিস্টাব্দে হাইপেশিয়া ঘোড়ার গাড়িতে ঘর থেকে বের হয়েছেন কাজে যাবার জন্য, পথে ধর্মান্ধ মানুষগুলো টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় একটা গির্জায় আর সেখানে এত্ত নৃশংসভাবে হত্যা করে যা ইতিহাসে ও খুব কম নজির আছে।
হাইপেশিয়ার মৃত্যুর সাথে সাথে থেমে যায় সভ্যতার বিকাশ। যেখানে হাইপেশিয়া সভ্যতার আলো হিসেবে জন্মেছিলেন সেখানে তার মৃত্যুর পর গ্রীক সভ্যতা আরো কয়েক হাজার বছর (বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুযায়ী ১০০০ বা ১২০০ বা ১৮০০) পর্যন্ত অন্ধকারেই ছিল।
বুঝতেই পারছেন এতটাই তার অবদান ছিল যার প্রভাবে বা তার অভাবে প্রায় এক হাজার বছর এই বিজ্ঞান অন্ধকার এই থেকে যায়।
তাছাড়াও তার মৃত্যুর পর লাইব্রেরির বইগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কথিত আছে দশ লক্ষের উপর এই বইগুলো পুড়তেও প্রায় ৬ মাস লেগেছিল।
ইতিহাসে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কি হতে পারে!
>>> ধর্মান্ধ মানুষগুলোর জন্য হয়তো তার গবেষণা ধ্বংস করা হয়েছে কিন্ত শেষ করতে পারেনি,মুছে দিতে পারে নি ইতিহাসের পাতা। কতিপয় নমুনা থেকেই মানুষ তার অবদান বুঝতে পেরে অসীম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এমনকি হাইপেশিয়া কে উৎসর্গ করে চাঁদের এক অঞ্চলের নাম দেওয়া হয়েছে “হাইপেশিয়া “
তাই চাঁদের সাথে সকলের মনে তিনি চির বিরাজমান থাকবেন।
আমাদের সমাজে কাউকে তুচ্ছ করা উচিত নয় কেননা সবার মাঝেই সুপ্ত প্রতিভা বিরাজমান। আমার আপনার একটু অনুপ্রেরণায় হয়তো সে প্রতিভার বিস্ফোরিত হওয়া সম্ভব।আর নারী বলে অবহেলা করার কোন প্রশ্ন আসেই না কেননা আমাদের সুপার হিউমেন মা-বোনেরা যেমন ১০ হাত দিয়ে পরিবার রক্ষা করে তেমনি দেশ-সমাজ তথাপি বিজ্ঞানের কল্যাণেও অবদান রেখে চলেছেন। তার এই যথাযথ স্বাক্ষর রেখেছেন হাইপেশিয়া ১৫০০ বছর পুর্বেই।