Nature Human Behaviour এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা মতে, মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনধারা তাদের জীবনসঙ্গীর জিন দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইউকে বায়োব্যাঙ্কে ৮০,০০০ এরও বেশি দম্পতির তথ্য ব্যবহার করে গবেষকরা ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের জীবনসঙ্গীর জিনোমের মধ্যে একাধিক পারস্পরিক সম্পর্ককে চিহ্নিত করেছিলেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে এই সংযুক্তিগুলোর প্রায় এক-চতুর্থাংশ আংশিক কার্যকরী ছিল। একজনের ডিএনএর উপর অন্য ব্যক্তির স্বাস্থ্য বা আচরণের বা জিনগত ব্যাপারগুলোর পরোক্ষ প্রভাব ছিল। এ নিয়ে এমিলি ম্যাকলিন, অক্সফোর্ড কলেজ অফ ইমোরি ইউনিভার্সিটি, জর্জিয়ার একজন ইভ্যুলেশনারি বায়োলজিস্ট, যিনি এই গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন না, বলেনঃ
“স্বজ্ঞাতভাবে মনে হয়, অবশ্যই আমাদের আচরণগুলি আমাদের চারপাশের ব্যক্তিদের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং সম্ভবত নিজেদের বহন করা জিন দ্বারাও প্রভাবিত হয়। দেখা যাক, গবেষণা কী বলে!!
প্রত্যক্ষ জিনগত প্রভাবগুলি, যা আপনার বাবা-মায়ের কাছ থেকে আসে ও আপনার ফিনোটাইপের উপর নিজস্ব জিনের প্রভাবকে প্রতিফলিত করে, কিন্তু পরোক্ষ জিনগত প্রভাবগুলি আপনার চারপাশের পরিবেশ এবং মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা প্রভাবিত। বিষয়টি স্পষ্ট করতে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে ব্যক্তি পরোক্ষ জিনগত প্রভাবে ধূমপান করে, সে সিগারেটের ধোঁয়াতে তাদের জীবনসঙ্গীর ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে বা তাদেরকেও ধূমপান করার জন্য উৎসাহিত করতে পারে।
বেশ কিছু গবেষণায়, পশুদের মধ্যে বেশিই এই পরোক্ষ জিনগত প্রভাবগুলো দেখা যায়। মানুষের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের, যেমন স্কুল সহপাঠীদের মধ্যে শিক্ষা বিষয়ক গুণাবলি অর্জনের ক্ষেত্রে, সহপাঠীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ধুমপান করা বা কেউ একজন অনেক মনোযোগী, তাকে দেখে নিজে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার মতো বিষয়গুলো দেখা যায়, যা পরোক্ষ জেনেটিক প্রভাব হিসেবে ধরা হয়। তবে এটি এখনও পরিষ্কার নয় যে এই সম্পর্কগুলি মানুষের ক্ষেত্রে কতটা বিস্তৃত, বা পারস্পরিক সম্পর্কের চেয়ে কার্যকরী কিনা।
বর্তমান একটি সমীক্ষায়, ইউনিভার্সিটি অফ এডিনবার্গের চার্লি জিয়া, অ্যালবার্ট টেনিসা এবং সহকর্মীরা ইউরোপীয় বংশদ্ভুত ৮০,৮৮৯ টি ভিন্ন ভিন্ন দম্পতির ডেটা ব্যবহার করেছেন যার জিনগত প্রকরণ, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার অভ্যাসগুলি ইউকে বায়োব্যাঙ্কে লিপিবদ্ধ রয়েছে। গবেষকরা ১০০ টি জটিল বৈশিষ্ট্য বেছে নিয়েছিলেন যা একাধিক জিনের পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত যেমনঃ উচ্চতা, ধূমপানের স্থিতি এবং মেজাজের পরিবর্তনগুলির প্রতি সংবেদনশীলতা ইত্যাদি। পাশাপাশি প্রতিটি ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য এবং তাদের জীবনসঙ্গীর ডিএনএর মধ্যে বিস্তৃত সংযোগের জন্য একটি পরিসংখ্যানিক মডেল ব্যবহার করেছিলেন।
দলটি আবিষ্কার করেন যে, এই বৈশিষ্টগুলোর ক্ষেত্রে প্রায় ৫০% জীবনসঙ্গীর জেনেটিক স্বভাবের সাথে কিছুটা সম্পর্ক দেখায়। জিয়া বলেন, “এই পারস্পরিক সম্পর্কগুলি সহজাত কারণে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, লোকেরা তাদের নিজস্ব অনুরূপ বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট জীবনসঙ্গী বেছে নেয় অনেক সময়ই।” তিনি আরও বলেন, উচ্চতা হল দম্পতিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ জিনগত প্রভাবের কারণে দেখা যাওয়া একটি বৈশিষ্ট্য, এতে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের তেমন কোনো প্রভাব নেই।
গবেষকরা অংশগ্রহণকারীদের ডেটাসেটে কম্পিউটার সিমুলেশন চালিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, কমপক্ষে প্রায় ২৫% সংযুক্তির ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তির জিনোটাইপটি অন্য ব্যক্তির ফিনোটাইপগুলিতে নির্ধারণযোগ্য প্রভাব ফেলছিল।
এই সংযুক্তির মধ্যে হাঁস-মুরগি এবং গরুর মাংস খাওয়া, টেলিভিশন দেখে সময় ব্যয় করা, মেজাজের পরিবর্তনের সংবেদনশীলতা এবং ধূমপানের অভ্যাসের মতো বেশ কয়েকটি ডায়েটারি বৈশিষ্ট্যও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও দলটি এর পিছনে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা জিন সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেন নি। জিয়া বলেন, এই বিশ্লেষণটি গবেষকদের এখন শুধুমাত্র বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জিনগত প্রভাবের ব্যাপারগুলো নিয়ে ধারণা দিচ্ছে।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মেলম্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের একজন মহামারী বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল বেলস্কি বলেছিলেন, এই ধরণের বিস্তৃত বিশ্লেষণ থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হলেও এই দলের সমীক্ষা এমন ধারণার প্রমাণ করে যে পরোক্ষ জিনগত প্রভাবগুলি মানুষের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তিনি এটিকে আচরণগত জেনেটিক্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উন্মুক্ত প্রশ্নের সমাধানের জন্য একটি বৃহৎ এবং শক্তিশালী ডাটাবেসের সৃজনশীল অ্যাপ্লিকেশন বলে অভিহিত করেছেন।জর্জিয়ার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড কলেজের বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী এমিলি ম্যাকলিন বলেন, “দলটির চিহ্নিত সংযুক্তিগুলো সম্পর্কে এবং কোন ব্যক্তির কোন নির্দিষ্ট জিনগুলি অন্য ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করার জন্য দায়ী, এ বিষয়ে তিনি জানতে আগ্রহী।” তিনি আরও বলেন, গবেষণায় ব্যবহৃত ইউকে বায়োব্যাঙ্কের কিছু ডেটা স্ব-প্রতিবেদন করা, তাই গবেষকদের এই প্রতিক্রিয়াগুলি মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলি সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে কিনা তা আরও পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আচরণের উপর জিনের প্রভাবের দিক নির্ধারণ করা এবং এটি জীবনসঙ্গীর জিনোটাইপের কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সাথে ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে যুক্ত কিনা- তাও বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি আকর্ষণীয় পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারে।
বেলস্কি বলেন, পরোক্ষ জিনগত প্রভাব সম্পর্কিত এ জাতীয় ডেটা একদিন জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হতে পারে। “এটিও সম্ভব হতে পারে যে, জীবনসঙ্গীর জিনোটাইপগুলির ভিত্তিতে রোগীদের ক্লিনিকাল গাইডেন্স এবং ঝুঁকি পরিচালনার তথ্য সরবরাহ করার জন্য জিনোমগুলি একজন ব্যক্তির চিকিৎসার রেকর্ডের একটি নিয়মিত অংশ হতে পারে।”
বেলস্কি আরও বলেন, গবেষণাটি জিনোটাইপ-ফেনোটাইপ সম্পর্কের জটিলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুস্মারক। এটি আপনি যাকে নিজের জীবন ভাগ করে নেওয়ার জন্য বেছে নিবেন সে ব্যক্তির জন্মগত জিনগত স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ঝুঁকি এবং সেগুলি থেকে রক্ষা করতেও ভুমিকা রাখবে। অর্থাৎ, এর মাধ্যমে আপনি সহজেই আপনার জীবনসঙ্গীর জেনেটিক সমস্যা সম্পর্কে জেনে, ভবিষ্যতে আপনার উপর তা কোন ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তা সম্পর্কেও সচেতন হতে পারবেন।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক