ক্রাস্টেসিয়ান [খোলসযুক্ত জলজ প্রাণী, যেমনঃ গলদা চিংড়ি] দ্বারা অনুপ্রাণিত প্রযুক্তি আমাদের মহাকাশের দূরবর্তী ঘটনা বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করতে পারে। যেমনঃ সুপারনোভা সংঘর্ষ এবং সৌর বায়ু যা আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সির অতীত সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্যে করবে।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক এক্স-রে, আমাদের ছায়াপথ ও মহাবিশ্বের বিকাশ বোঝার চেষ্টা করছে। বর্তমানে মনে করা হয় গলদা চিংড়ি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এটি করতে সাহায্য করতে পারে। একটি নতুন প্রযুক্তি যা গলদা চিংড়ির চোখের গঠন অনুকরণ করে তৈরি করা হয়েছে। এই প্রযুক্তি এক্স-রে জ্যোতির্বিদ্যায় বিপ্লব ঘটাতে পারে।
গলদা চিংড়ির দুটি বিশেষ চোখ রয়েছে যার মাধ্যমে তারা কম আলোর পরিবেশেও নড়া চড়া অনুভব করতে পারে। তাদের এই অনন্য কাঠামোকে অনুকরণ করে, বিজ্ঞানীরা বিপথগামী এক্স-রে ক্যাপচার করার লক্ষ্যে পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে মিশনের জন্য ভিজ্যুয়াল সরঞ্জাম বা অপটিক্স তৈরী করছে।
ভবিষ্যতে, আকাশের কাছের ও দূরের জ্যোতিবিজ্ঞানের ঘটনা গুলিকে সনাক্ত করতে এই কৌশলটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রসারিত করবে।
এক্স-রে কি?
এক্স-রে হচ্ছে মহাকাশীয় বস্তু থেকে নির্গত হওয়া এমন একটি রশ্মি যা অন্যন্ত গরম। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোল, গ্যালাক্সি ক্লাস্টার, বিস্ফোরিত নক্ষত্র এবং অধরা রয়ে যাওয়া অন্যান্য উচ্চ-শক্তির ঘটনা সম্পর্কে আরও জানতে তাদের অধ্যয়ন করে থাকেন।
ভবিষ্যতে গলদা চক্ষু দ্বারা অনুপ্রাণিত প্রযুক্তি মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এক্স-রের উৎসকে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
২০০৬ সালে ইউনিভার্সিটি অফ লিসেস্টার এর স্পেস রির্সাচ সেন্টারের পরিচালক জর্জ ফ্লেজার বলেছেন, গলদা চিংড়ি- ভিত্তিক অপটিক্স জ্যোতিবিজ্ঞানীদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, যে ধূমকেতু থেকে তারা এবং কোয়াসার থেকে সর্বনাশা সুপারনোভা ইভেন্ট পর্যন্ত কিভাবে কাজ করছে তা বোঝার জন্য।
কি গলদা চিংড়ির চোখকে অসাধারণ করে তোলে?
গলদা চিংড়ি সমুদ্র পৃষ্ঠের প্রায় ২,৩০০ ফুট নীচে তাদের অন্ধকার ঘোলাটে আবাসস্থলে মানিয়ে নেয়ার জন্য তাদের চোখকে বিশেষ ভাবে তৈরি করে নিয়েছে। যদিও তারা ভালোভাবে দেখতে পারে না, কিন্তু তারা সংবেদনশীল গতিকে দুর্দান্ত ভাবে অনুভব করতে পারে। মানুষের চোখের বৃত্তাকার লেন্স যেখানে আলোর প্রতিসরণের ওপর নির্ভর করে, অন্যদিকে গলদা চিংড়ির চোখ আলোর প্রতিফলনের উপর নির্ভর করে। তাদের দুটি চোখের প্রতিটিতে ১০,০০০ টির মতো বর্গাকৃতির টিউব রয়েছে, যা এক সাথে গুচ্ছ বন্দী থাকে। প্রতিটি টিউব সমতলভাবে সারিবদ্ধ থাকে, যখন আলো সরাসরি রেটিনার নিচে আগাত করে তখন টিউবগুলি আয়নার মতো কাজ করে।
এই ক্ষুদ্র কোষগুলি আলোকে আটকাতে পারে-এমনকি অন্ধকারেও এটি চোখের ফটোরিসেপ্টরগুলির স্তরে ফোকাস করতে পারে। গলদা চিংড়ির এই দৈহিক গঠনের কারণেই তারা ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত দেখতে পারে যেখানে মানুষ ১২০ ডিগ্রি পর্যন্ত দেখতে পারে।
অনুপ্রেরণা মূলক দৃষ্টিভঙ্গি:
১৯৭৮ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিবিজ্ঞানী রজার অ্যাঞ্জেল প্রাণীর দর্শন সম্পর্কে একটি বৈজ্ঞানিক আর্টিকেল পড়ে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে গলদা চিংড়ির চোখের অনুকরণকারী অপটিক্যাল যন্ত্র গতানুগতিক এক্স-রে টেলিস্কোপের তুলনায় উচ্চ শক্তিসহ অনেক বেশি ক্যাপচার করতে পারবে।
এক্স-রে রশ্মিগুলো আয়নার মতো পৃষ্ঠগুলি (বিশেষ করে যখন আয়নাগুলি চেপ্টা অ্যাঙ্গেলে থাকে) থেকে প্রতিফলিত হতে পারে। এজন্যে এক্স-রে যন্ত্রগুলিকে সংকীর্ণ ক্ষেত্রে রাখতে হবে। অ্যাঞ্জেল অনুমান করেছিলেন যে গলদা চিংড়ি-ভিত্তিক যন্ত্র সমস্ত দিকের নির্দেশনা দিবে ও আকাশের অনেক বড় অংশ থেকে এক্স-রে ক্যাপচার করবে।
১৯৯২ সালে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রথম লবস্টার-আই অপটিক্স ব্যবহার করে এক্স-রে পরিমাপ করতে সফল হন। এই প্রযুক্তিটি মহাকাশ মিশনের সাথে মানিয়ে নিতে আরও ১৫ বছর সময় লেগেছে। নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের (Goddard Space Flight Center) একজন জ্যোতিপদার্থবিদ স্কট পোর্টার বলেছেন, ‘এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা জ্যোতিপদার্থবিদ্যায় দীর্ঘদিন রয়েছে, শুধু একটি ব্যবহার খোঁজে।’
পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে সৌর বায়ু কিভাবে মিথস্ক্রিয়া করে তা বোঝার জন্য পোর্টারের দল বিশেষ যন্ত্র তৈরি করেছে যার মধ্যে রয়েছে, সোলার-টেরেস্ট্রিয়াল অবজারভার ফর দ্য রেসপন্স অফ দ্য ম্যাগনেটোস্ফিয়ার (STORM)। সাধারণত, বর্তমানের এক্স-রে টেলিস্কোপ গুলি কেবলমাত্র অর্ধ-ডিগ্রি প্রতিবিম্ব ধারণ করতে পারে। অন্যদিকে, STORM-এ গলদা চিংড়ি দ্বারা অনুপ্রাণিত অপটিক্স যন্ত্রটি ২০-বাই-২০ ডিগ্রির প্রতিবিম্ব ধারণ করতে পারে, যা পূর্বের প্রযুক্তির তুলনায় ৪০ গুণ বড় এলাকা ক্যাপচার করতে পারে।
পোর্টার বলেছেন, ❝আমরা এই দৈত্যকার বস্তু মধ্যে দিয়ে প্রতিবিম্বের ছোট অংশ দেখতে চাই না। আমরা পুরো জিনিসটা দেখতে চাই। আমাদের একটি খোলা বিস্তীর্ণ কিছু দরকার। এই গলদা চিংড়ির চোখ গুলি আমাদের তা দিতে সক্ষম।❞
এই অপটিক্স তৈরি করতে নির্মাতারা হাজার হাজার ছোট কাচের টুকরো গুলিকে টিউব বান্ডিলে রুপান্তর করেন। দৃশ্যমান আলো প্রতিফলিত করতে পারে এমন আয়না এক্স-রে শোষণ বা প্রেরণ করে। তাই নির্মাতারা ইরিডিয়াম দিয়ে টিউবকে আবরণ করে। তারপরে তারা এক্স-রে-কে একক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করার জন্য টিউবটিকে তাপ দেয় এবং গোলাকার আকৃতি তৈরি করে।
এই যন্ত্রের কারণে একটি অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া গিয়েছে। তা হলো, সরঞ্জামগুলির মধ্যে অনেক সরঞ্জাম প্রথাগত এক্স-রে যন্ত্রের তুলনায় অনেক হালকা এবং ছোট। তাই এই সরঞ্জাম গুলি মাল্টি-ইনস্ট্রুমেন্ট মিশনে অর্ন্তভুক্ত করা সহজ।
কিছু প্রস্তাবিত প্রকল্প আমাদের ছায়াপথের বাইরের মহাবিশ্বকে আরও ভালো জানতে পারবে। ২০১৮ সালে নাসা গডার্ডের একদল গবেষক একটি অস্থায়ী অ্যাস্টোফিজিক্স অবর্জাভারের (একটি ওয়াইড-ফিল্ড রোবটিক টেলিস্কোপ) উপর লবস্টার আই অপটিক্স ব্যবহার প্রস্থাব করে ছিলেন। হাই-এনার্জি ইভেন্ট, যেমন নিউট্রন তারা একত্রীকরণ, এক্স-রে আফটার গ্লো, সেই সাথে গামা-রে বিস্ফোরণ এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সংকেত তৈরি করে। এই যন্ত্রটি উল্লেখযোগ্য এক্স-রে নির্গমন বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের উৎস ও অবস্থান খুঁজে পেতে আকাশকে স্ক্যান করে। এটি পর্যবেক্ষকদের মহাকাশকে আরও কাছ থেকে দেখতে সাহায্যে করে।
অন্যান্য প্রকল্পগুলি আরও স্থানীয় কেন্দ্রবিন্দু নেয়। যেমন, STORM নাসার অনুমতি চাইছে পৃথিবী এবং চাঁদের মাঝখানের অর্ধেক প্রদক্ষিণ করতে। গলদা চিংড়ির অনুকরণীয় টেলিস্কোপ একমিনিটে টাইম স্কেলে সৌর বায়ু-চুম্বক ক্ষেত্রের মিথস্ক্রিয়া গুলির ছবি ধারণ করতে পারে। এটি পূর্ববর্তী মহাকাশযানের থেকে একটি বিশাল উন্নতি। পূর্বে একটি একক ছবি তৈরি করতে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত সময় লাগতো।
ইতিমধ্যে লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল বুধ থেকে এক্স-রে নির্গমন বুঝতে একটি যন্ত্র তৈরি করেছে। এটি হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র বর্গাকার কোষ দিয়ে তৈরি। তাদের এই স্পেকট্রোমিটার MIXS নামে পরিচিত। এটি একটি ইউরোপিয়-জাপানি মিশনের অংশ। এটি এখন দ্রুতগতিতে প্ল্যনেটের দিকে যাচ্ছে এবং ২০২৫ সালে আগমনের পথে রয়েছে।
পরিশেষে পোর্টার বলেছেন, সম্প্রতিক বছর গুলিতে গলদা চিংড়ি-ভিত্তিক যন্ত্রগুলি স্থাপনের জন্য আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি আরও বলেন প্রকল্পগুলি তহবিল পাচ্ছে। তাই এই গলদা চক্ষু আমাদের রহস্যময় মহাবিশ্ব বোঝার হাতিয়ার।
আরাফাত রহমান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ Astronomy