Chemotherapy বা কেমোথেরাপি:
Chemotherapy বা কেমোথেরাপি হলো এক ধরণের ক্যান্সার চিকিৎসা যাতে ক্ষতিকর ক্যান্সার কোষগুলি হ্রাস এবং বংশবৃদ্ধি রোধ করতে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের চিকিৎসায় মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে কেমোথেরাপি। এর সাথে অন্যান্য চিকিৎসার সহায়তায় ক্যান্সারকে আরও ছড়িয়ে পড়া থেকে রোধ করা যাচ্ছে, এমনটাই বলেছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রোপচারের একজন সহকারী ক্লিনিকাল অধ্যাপক ড. ডীনা আত্তাই।
কেমোথেরাপি আবিষ্কারঃ
কেমোথেরাপি প্রকৃতপক্ষে বিষাক্ত মাস্টার্ড গ্যাসের প্রভাব গবেষণার সময় এক দুর্ঘটনায় উদ্ভাবিত হয়েছিল।
১৯৪২ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনদের যুক্ত হওয়ার পর, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডাঃ আলফ্রেড গিলম্যান এবং ডাঃ লুই গুডম্যানকে মার্কিন সরকার মাস্টার্ড গ্যাসের বিষাক্ত প্রভাবের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে নিযুক্ত করেছিল। ২০০১ সালের ইয়েল জার্নাল অফ বায়োলজি অ্যান্ড মেডিসিনে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গর্তে নিষ্কৃত এই ক্ষতিকারক গ্যাস ৯১,০০০ এরও বেশি সৈন্যের মৃত্যুর জন্য দায়ী এবং এই গ্যাসের প্রভাবে সেই যুদ্ধের সময় ২.২ মিলিয়নেরও বেশি লোক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
অতীতে খরগোশের উপর করা পরীক্ষায় দেখা গেছে মাস্টার্ড গ্যাস ক্ষতিকারক কারণ এটি শ্বেত রক্তকণিকা কে মেরে ফেলে, যা শরীরের ইমিউন সিস্টেমের প্রধান কোষ। এই পরীক্ষাটি গিলম্যান এবং গুডম্যানকে ভাবায় যে মাস্টার্ড গ্যাসটি একটি ভিন্ন ধরণের রোগ, যেমন: রক্তের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ব্যবহৃত হতে পারে। মাস্টার্ড গ্যাস ইঁদুরের রক্তের ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করতে পারে তা নিশ্চিত করার পরে, গবেষকরা মানুষের মধ্যে এই হাইপোথিসিস পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রথম রোগী:
তাদের প্রথম মানব রোগী জেডি ছিলেন একজন পোলিশ অভিবাসী, তিনি ছিলেন লিম্ফ্যাটিক ক্যান্সারে আক্রান্ত- এটি লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে অর্থাৎ লসিকাতন্ত্রের ক্যান্সার যেটি শ্বেত রক্তকণিকাকে আক্রমণ করে, এটি রেডিয়েশনসহ অন্যান্য কোনো থেরাপিতেও সাড়া দেয়নি। মাস্টার্ড গ্যাস দিয়ে রাসায়নিক চিকিৎসার শুরুতে মনে হয়েছিল যে এটি জেডির ক্ষেত্রে কাজ করছে। কারণ এর ফলে তার টিউমারগুলি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে, তিনি আবার শক্তি এবং গতিশীলতা অর্জন করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু জেডির ক্ষেত্রে এই চিকিৎসার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রচুর রক্তপাত এবং হাড়ের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিলো, যার ফলে সে তিন মাসের মধ্যে মারা যায়।
সেই প্রথম রাসায়নিক চিকিৎসা বা কেমোথেরাপি দেওয়ার পরে এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। এর ফলে অন্যান্য কেমোথেরাপি ওষুধের উন্নতি হয়েছে, যা নিরাপদ, আরও কার্যকর এবং কম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াসম্পন্ন। এই ওষুধগুলির মধ্যে অ্যালক্লেটিং এজেন্ট এবং অ্যান্টিটিউমার অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে। এই দুটিই ক্যান্সার কোষগুলির ডিএনএ নষ্ট করে এবং কোষের রেপ্লিকেশন রোধ করে।
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি (ACS) এর মতে অন্যান্য ওষুধের মধ্যে যেগুলোতে টোপোসোমেরাজ ইনহিবিটরস এবং মাইটোটিক ইনহিবিটার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেগুলো ওইসব এনজাইমের ক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে বা কোষ বিভাজন রোধ করে যারা ক্ষতিকর কোষের প্রজননের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন প্রেরণ করে। জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট–এর নির্দেশনা অনুসারে কোন রোগীকে কোন ওষুধ দেওয়া হবে তা ক্যান্সারের ধরণ এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে।
কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন এক নয়ঃ
কেমোথেরাপিকে প্রায়ই মানুষ রেডিয়েশনের সাথে গুলিয়ে ফেলে, যদিও এই দুটি চিকিৎসা খুব আলাদা। ড. আত্তাই লাইভ সাইন্স কে বলেন, “কেমোথেরাপি পুরো শরীরে কাজ করে অন্যদিকে রেডিয়েশন থেরাপি সার্জারির মতো শরীরের নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলিতে বিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা করে।”
যেহেতু কেমোথেরাপি পুরো শরীরে কাজ করে তাই এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের চিকিৎসায় অধিক কার্যকর। ক্যান্সারের কোষগুলি যখন দেহের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়, কেমোথেরাপির মাধ্যমে এই কোষগুলিকে শরীরের অন্যান্য অংশে যাওয়ার সময় নষ্ট করে ফেলা হয়। প্রচলিত চিকিৎসা, যেমন তেজস্ক্রিয়তা বা অন্যান্য চিকিৎসায় সাহায্যে এই ভ্রমণকারী কোষগুলোকে সহজে নষ্ট করা যেতো না!
ড. আত্তাই আরো বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য হল এই (Chemotherapy বা কেমোথেরাপি) ওষুধটি পুরো রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া, যাতে কোনও লুকানো ক্যান্সার কোষ যারা স্থায়ীভাবে বাসা বাধেনি বা অন্য কোষকে সংক্রমিত করেনি তাদেরকে দ্রুত নষ্ট করে ফেলা যায়।”
Chemotherapy বা কেমোথেরাপি-এর প্রক্রিয়াঃ
কেমোথেরাপির জন্য নির্ধারিত রোগীদের ঔষধটি ইন্ট্রাভেনাস (আইভি) ড্রিপ, ইঞ্জেকশন বা মৌখিকভাবে (পিল, ক্যাপসুল বা তরল হিসাবে) গ্রহণ করতে হয়।
আইভি ইনফিউশনে কয়েক ঘন্টা সময় লাগতে পারে, তবে কেমোথেরাপি গ্রহণের প্রক্রিয়াটি মোটেও কষ্টকর নয়। ওরাল কেমোতে রোগী বাড়িতে বসে এই চিকিৎসাটি গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এই জাতীয় ওষুধগুলি রোগীকে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুসরণ করতে হয়, কিছু লোকের এর জন্য গ্লাভস পরতে হয় এবং ঠিক মতো ওষুধ গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। এসিএস (ACS) তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, “ওরাল কেমো ডোজ সেটআপ করা হয় যাতে ক্যান্সার কোষগুলি মারার জন্য আপনার শরীরে একই লেভেলের ওষুধ থাকে। আপনি যদি সঠিকভাবে ওরাল কেমো গ্রহণ না করেন তবে কেমোথেরাপি যথাযথভাবে কার্যকর হবেনা।”
আইভি বা মৌখিক চিকিৎসার পরে রোগীদের ব্যথা অনুভব করা স্বাভাবিক। প্রায়শই এই ব্যথাগুলো হয় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার জন্য।
উদাহরণস্বরূপ, রোগীরা প্রায়ই নিউরোপ্যাথির কারণে তাদের স্নায়ুতে ব্যথা অনুভব করেন বা কেমোথেরাপির ওষুধগুলির কারণে তাদের নার্ভের ক্ষতি হয়। কখনও আবার রোগীরা হাড়ের ব্যথার কথা বলেন, কিন্তু এটি কেমোথেরাপির কারণে হয় না। বরং এটি নিউপোজেন এর কারণে হয়, এই ওষুধটি কেমোথেরাপির সময় হাড়ের মজ্জার উন্নতির জন্য দেওয়া হয়। এর ফলে শ্বেত রক্ত কণিকার উৎপাদন কেমোথেরাপির সময় হ্রাস পেতে পারে।
মৌখিক এবং আইভি কেমোথেরাপির উভয় ক্ষেত্রেই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যেহেতু কেমোথেরাপি সারা শরীর জুড়ে ক্যান্সার কোষগুলিকে আক্রমণ করে তাই এটি ক্যান্সারের কোষগুলির পাশাপাশি কিছু ভালো কোষেরও ক্ষতি করতে পারে। যেসব কোষ দ্রুত বিভক্ত হয় সেগুলি কেমোথেরাপির সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কেমোথেরাপির ফলে চুল পড়ে যায় কারণ চুলের ফলিকলের যে কোষগুলি সাধারণত কয়েকদিন পর পর উৎপন্ন হয় সেগুলো মারা যায়।
এছাড়া যে কোষগুলি দ্রুত বিভক্ত হয় সেগুলির মধ্যে রয়েছে অন্ত্রের আস্তরণ, শ্বেত রক্তকণিকা, স্বাদের কুঁড়ি (টেস্টবাড) এবং ত্বক। কেমোথেরাপি শরীরের এই অঞ্চলগুলিকে আক্রমণ করে যার ফলে বমি বমি ভাব হয়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়, ত্বক ফেটে যায় এবং স্বাদ বোধ নষ্ট করে দিতে পারে।
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির মতে, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো বেশিরভাগ রোগীর মধ্যে কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে দেখা যায়। মেয়ো ক্লিনিক অনুসারে, চিকিৎসার পরে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে চুল ফিরে আসে। কিন্তু কেমোথেরাপির প্রভাবগুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলে কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এড়ানো যায়। কারণ ডাক্তাররা কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, যেমন বমি বমি ভাব কাটিয়ে উঠার জন্য ওষুধ দিতে পারেন।
কেমোথেরাপির কার্যকারিতাঃ
আপনার প্রথম কেমোথেরাপির চিকিৎসার সময় আপনি হয়তো নার্ভাস হয়ে যেতে পারেন। কারণ এটি বেশ জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি, তাই ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। সমস্ত কেমোথেরাপির ফলাফল কিন্তু এক নয়। কারো এর ফলে খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে তার মানে এটা না যে আপনারও হবে।
আত্তাই এর ভাষ্যমতে, “কেমোথেরাপি সব ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে, বিশেষত যেসব ক্যান্সার দ্রুত ছড়ায় না তাদের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপির মাধ্যমে রোগীর উন্নতি করার সম্ভাবনা কম হতে পারে। এটি স্পষ্ট করে বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, কেমোথেরাপির উপকারিতা ক্যান্সারের নির্দিষ্ট ধরণ এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা ক্যান্সারটি সম্পর্কে কতটুকু জানি তার উপর নির্ভর করে।”
তিনি আরও বলেছেন, “বর্তমানে ক্যান্সারের চিকিৎসা আরও সূক্ষ্মভাবে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে নির্দিষ্ট ক্যান্সার কোষকে নষ্ট করা এবং ভালো কোষগুলির ক্ষতি না করা। আশা করছি কিছু থেরাপির মাধ্যমে আমরা নির্দিষ্ট টিউমার কোষেরআণবিক কাঠামো বা জেনেটিক মিউটেশনগুলো শনাক্ত করতে পারবো।”
নিশাত তাসনিম/ নিজস্ব প্রতিবেদক