গবেষকরা কোভিড-১৯ সম্পর্কে অনেক গবেষণা করছেন। এখন পর্যন্ত তারা এ সম্পর্কে কি জানলেন এবং তারা কি পৃথিবীকে কি এই মহামারী থেকে মুক্ত করতে পারবেন ?
করোনা ভাইরাস দীর্ঘদিন ধরে মানবজাতির জন্য সমস্যা তৈরি করে আসছে। এ ভাইরাসের কিছু সংস্করণ সাধারণ সর্দি জ্বরের কারণ হিসেবে পাওয়া যায়। সম্প্রতি এর দুটো টাইপ মারাত্মক অসুস্থতার সৃষ্টি করেছেঃ
১. গুরুতর তীব্র শ্বাসকষ্টের লক্ষণ (SARS)
২. শ্বাসতন্ত্রের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ (MARS)
তবে তাদের প্রভাব কোভিড-১৯ দ্বারা সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের এর থেকে তুলনামূলক কম হয়েছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এটি বিশ্বজুড়ে লকডাউনের সৃষ্টি করেছে এবং রোগটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
এই সম্পূর্ণ মহামারীটি জেনেটিক পদার্থ দিয়ে আবৃত সূচালো ফ্যাটযুক্ত রাসায়নিক লিপিড এর একটি অসাধারণ কৃতিত্ব এবং যা পরিমাপে ১ মিটার ব্যাসের ৮০ বিলিয়নতম অংশ।
অন্যদিকে SARS-Covi-2 ভাইরাসকে কোভিড-১৯ এর কারণ বলা হচ্ছে। বলা যায় এ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই কম। ৫ মাস আগেও এটি বিজ্ঞানের অজানা একটি ভাইরাস ছিল কিন্তু বর্তমানে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভ্যাকসিন প্রকল্পগুলো দীর্ঘমেয়াদে অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের পরীক্ষা চালু করেছে এবং ডায়াগনস্টিক ট্রায়াল চলছে।
তাই আমাদের প্রশ্নগুলোও সোজাঃ গত পাঁচ মাসে আমরা এ থেকে কি শিখেছি এবং কিভাবে সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এই মহামারীটির অবসান ঘটাতে পারি?
★ এটি কোন জায়গা থেকে এসেছে এবং এটি কিভাবে প্রথম মানুষকে সংক্রমিত করেছিল?
গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন SARS-Covi-2 অবশ্যই বাদুর থেকে উদ্ভূত। যা ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিজ দেহে মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জাগিয়ে তুলেছিলো। এই প্রতিরক্ষার সাথে যুদ্ধ করা ভাইরাসটিকে কে দ্রুত রেপ্লিকেট করতে প্ররোচিত করে, যাতে তারা পূর্বের বাদুরের প্রতিরোধ ক্ষমতার চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে। সেই পরিবর্তিত ভাইরাস যুক্ত বাদুড়গুলো দ্রুত বংশ বিস্তার করে সংক্রমণ যুক্ত বাদুরের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। এভাবে ভাইরাসটি অন্যান্য প্রাণীর দেহে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যাদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই। ভাইরাসগুলো আস্তে আস্তে নতুন হোস্টে ছড়িয়ে পড়ছে। সর্বাধিক প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে, SARS-Covi-2 মানুষকে মধ্যস্থতাকারী প্রজাতি যেমনঃ প্যাঙ্গোলিনের মাধ্যমে সংক্রমিত করতে শুরু করেছিল।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর এডওয়ার্ড হোমস বলেছেন “এই ভাইরাসটি সম্ভবত বাদুড় থেকে অন্যসব প্রাণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখান থেকে যেসব প্রাণী মানুষের কাছাকাছি বসবাস করে ও পরবর্তীতে মানুষের সংস্পর্শে আসে। এটি ভাইরাসটি মানুষের মাঝে ছড়ানোর একটি সম্ভাব্য কারণ। পরবর্তীতে সেই মানুষটিই তার ঘরে যাবে এবং অন্যদের মধ্যেও ভাইরাসটি ছড়াবে। এভাবেই ভাইরাসটি মহামারী আকার ধারণ করছে।”
SARS-Covi-2 ভাইরাসটি মূলতঃ ভাইরাসযুক্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মধ্য দিয়ে ছড়ায় এবং অন্য ব্যক্তিকে সংক্রমিত করে।
★কিভাবে ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মানুষকে প্রভাবিত করছে?
আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে বাতাসে ছড়ানো ভাইরাসযুক্ত কণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে অন্য দেহে ছড়ায়। ভাইরাসগুলো দেহের গলা এবং ল্যারিংক্সের আবরণের কোষগুলোর সংস্পর্শে আসে। এই কোষগুলোর বিপুল পরিমাণ রিসেপ্টর রয়েছে যা Ace-2 রিসেপ্টর নামে পরিচিত। নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক জোনাথন বল বলেছেন, “এই ভাইরাসের উপরের পৃষ্ঠে প্রোটিন রয়েছে যা সেই রিসেপ্টরটি বন্ধ করে তার কোষের RNA দেহকোষে স্থানান্তর করে দেয়। সেই RNA নিজেকে কোষের নিজস্ব প্রতিস্থাপনের সিস্টেমে ঢুকে এবং ভাইরাসের একাধিক অনুলিপি তৈরি করে। এরপর এগুলো কোষ থেকে বেরিয়ে পড়ে এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে যায় পুরো শরীরে। ইমিউনিটি সিস্টেম দ্বারা উৎপন্ন অ্যান্টিবডি শেষ পর্যন্ত ভাইরাসটিকে টার্গেট করে এবং বেশিরভাগ সময় এর কার্যক্রম কে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়।”
বল আরও বলেন, “এই কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ হলে সাধারণত গুরুতর কোনো লক্ষণ প্রকাশ করে না যা এই ভাইরাসের সাফল্যের অন্যতম গোপন বিষয়। অনেক মানুষ বুঝতেও পারেনা তারা সংক্রমিত হয়েছেন এবং তারা ঘর-বাড়ি, কাজের জায়গা, সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায় ও সংক্রমণটি ছড়িয়ে দেয়।”
SARS- যা করোনা ভাইরাস দ্বারা ঘটে তা রোগীদের অনেক অসুস্থ করে ফেলে এবং আক্রান্তদের ১০ জনের মধ্যে ১ জন মারা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে আলাদা করে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং তা ট্রান্সমিশন চেইন দ্বারা অন্যদের সংক্রমণ হওয়া বন্ধ করে।
★ভাইরাসটি কেন কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ হচ্ছে?
ভাইরাসটি মূলত ফুসফুসে আক্রমণ করে। এটি মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে যখন এটি শ্বাসনালির নিচে চলে যায় এবং ফুসফুসকে সংক্রমিত করে। অনেক কোষ ধ্বংস হয় এবং ফুসফুসের অনেক কোষ অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই ক্ষেত্রে রোগীকে নিবিড় পরিচর্যায় চিকিৎসা করা প্রয়োজন। আরও খারাপ হয় যখন কোন ক্ষেত্রে রোগীর ইমিউনিটি সিস্টেম ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ওভারড্রাইভে এ চলে যায়। যখন রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলো ধ্বংস হয় এবং সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যার কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
★ তাহলে আমরা কি সুরক্ষিত যদি আমরা একবার সংক্রমিত হই?
কোভিড-১৯ সংক্রমণের থেকে পুনরুদ্ধার পাওয়া রোগীদের রক্ত পরীক্ষা করে ডাক্তাররা রক্তের অ্যান্টিবডি গুলো নিউট্রাল করার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা করছেন। এই অ্যান্টিবডিগুলো ইমিউন সিস্টেম দ্বারা তৈরি হয় এবং নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে আক্রমণকারী ভাইরাসকে আবৃত করে রাখে এবং কোষগুলোতে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে।
ইম্পেরিয়াল কলেজের ভাইরোলজিস্ট মাইক স্কিনার বলেন, “এটি স্পষ্ট যে সংক্রমিত ব্যক্তিদের দেহের ইমিউনিটি সিস্টেম ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এবং এই প্রতিক্রিয়ার ফলে তৈরি অ্যান্টিবডি গুলো ভবিষ্যতের সংক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করবে কিন্তু আমাদের লক্ষ্য করা উচিত এটা জীবের স্থায়ী সুরক্ষার জন্য অসম্ভব।”
বেশিরভাগ ভাইরোলজিস্ট বিশ্বাস করেন, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল ১/২ বছর স্থায়ী হবে। এর মানে বেশিরভাগ মানুষ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠলেও এটি এখনো স্থায়ী হয়ে উঠতে পারে অর্থাৎ মৌসুমী রোগ হিসেবে এটি স্থায়ী হতে পারে। আশা করি কোভিড-১৯ সম্পর্কিত একটি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে যাব আমরা।
সংক্ষেপে তাই বলা যায় ভাইরাসটি কিছু সময়ের জন্য আমাদের সাথে থাকবে।
কিন্তু এটির প্রভাব কি অধিক তীব্র হতে পারে?
কিছু গবেষক বলেছেন এটি কম মারাত্মক হতে পারে। আবার কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়েছেন যে এটি আরো মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। স্কিনার এ ব্যাপারে সন্দিহান। তিনি বলেছেন, “এই মুহূর্তে ভাইরাসের অবস্থান মহামারী বলতে পারি কারণ এটি খুব তীব্রভাবে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।”
স্কিনার আরও বলেছেন, “আশা করা যায় শেষ পর্যন্ত একটি কার্যকর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করা হবে যা আমাদের কোভিড-১৯ এর হুমকি থেকে রক্ষা করবে।”
★আমরা কবে নাগাদ একটি ভ্যাকসিন পেতে পারি?
গত ৯ এপ্রিল জার্নাল নেচার প্রকাশ করে ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে ৭৮ টি ভ্যাকসিন প্রকল্প শুরু করা হয়েছে আরো ৩৭ টির কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চলছে। যে প্রক্রিয়াগুলোর কাজ চলছে তার মধ্যে একটি ভ্যাকসিন প্রকল্প রয়েছে যা বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালগুলোর মধ্যে রয়েছে। আরও ২টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বায়োটেকনোলজি কর্পোরেশন আর ৩টি চায়নার বৈজ্ঞানিক গবেষণা দল রয়েছে। অনেকের উদ্ভাবকরা বলছেন এই বছরের মধ্যে তারা হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করার চিন্তা করছেন।
এই অসাধারণ প্রতিক্রিয়া আশা জাগিয়ে তোলে যে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন অতি অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি করা যেতে পারে। তবে এর জন্য বড় আকারে সুরক্ষা ও কার্যকারিতা জ্ঞানের প্রয়োজন। কিন্তু নিঃসন্দেহে এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া বলা যায়।
কিছু বিজ্ঞানী ভ্যাকসিন আবিষ্কার প্রক্রিয়ার গতি বাড়ানোর জন্য একটি উপায় প্রস্তাব করেছেন- “ভ্যাকসিন এর কার্যকারিতা নির্ধারণের জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবীদের দেহের মধ্যে ভাইরাস প্রবেশ করানো”। রাটগার্স ইউনিভার্সিটি এর অধ্যাপক নির এয়াল বলেন যে, “এই পদ্ধতি ঝুঁকিবিহীন নয় তবে বেশ কয়েক মাসের মধ্যে প্রার্থীদের ভ্যাকসিন পরীক্ষা দ্রুত করার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তাদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবান হতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “তাদের স্বাস্থ্যের উপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং তাদের নিবিড় পরিচর্যা করা হবে। এতে বোঝা যাবে কোন ওষুধ তাদের দেহে কাজ কেমন কাজ করছে”। ফলাফলস্বরূপ এমন একটি ভ্যাকসিন তৈরি হতে পারে যা সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে তিন ধাপের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেয়ে সফল হতে পারবে এবং লক্ষ লক্ষ জীবন বাঁচাতে পারবে।
তবে ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিশেষ স্বেচ্ছাসেবীদের সংক্রমিত করা, যাদের পরীক্ষার অংশ হিসেবে একটি প্লেসিবো ভ্যাকসিন দেওয়া হবে- এটি খুবই বিতর্কিত। ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ্যাডাম ফিন বলেন, “এটি খুব সাবধানতার সাথে চিন্তা করতে হবে।কারণ তরুণরা এ জাতীয় পরীক্ষায় যোগদানের সুযোগে ঝাপিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এটি এমন একটি ভাইরাস যা মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে।”
যাইহোক ভ্যাক্সিনের ৩ ধাপের ট্রায়াল এখনো অনেক দূরে রয়েছে। তাই এই ধারণাটি সাবধানতার সাথে বিবেচনা করার জন্য আমাদের কাছে সময় আছে। তাছাড়া, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া সর্বশেষ তথ্যমতে, ভাইরাসটি এই পৃথিবীতে স্থায়ী হয়ে যেতে পারে, যার জন্য আমাদের এখন প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই বেশি প্রয়োজন।
রাদিয়া আহমেদ লুবনা/ নিজস্ব প্রতিবেদক
+1
+1
+1
+1
+1
+1
+1