বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে একটু চোখ বুলালেই আপনি হয়তো দেখে থাকবেন রংচঙা থাম্বনেইল যুক্ত ভিডিও কিংবা, অখ্যাত কোন নিউজ সাইটের মিথ্যে কিছু খবর, যেমন- “করোনা ভাইরাসটি মূলত চীনের গবেষণাগারে তৈরী মারণাস্ত্র”, আবার কোনোটা এর থেকেও এক কাঠি এগিয়ে এসে বলে, “কোন পারমাণবিক বোমা ব্যবহার না করেও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ জিতে গেলো চীন” – এসব খবর কি সত্য? যদি মিথ্যা হয় তাহলে সত্যটা কি? জানতে একটু গভীরে যাওয়া যাক!
নতুন করোনাভাইরাস পরীক্ষাগারে তৈরি কোনো ভাইরাস নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। মঙ্গলবার সংস্থাটি জানায়, এটি গত বছর চীনে প্রাণির শরীর থেকেই সংক্রমিত হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।
ডব্লিউএইচও বলছে, এই ভাইরাস যে প্রাণিদেহ থেকে উৎসারিত এবং এটি গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়নি, তার পক্ষে যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপস এবং জন হপকিন্সের যৌথ এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ভাইরাসের উৎস হতে পারে- বাদুড় কিংবা , বনরুই জাতীয় প্রাণি। তবে , বিবিসি’র খবর অনুযায়ী- পেশেন্ট জিরো ওয়ে গুশিয়ান ( ধারণাকৃত নাম ) ছিলেন একজন চিংড়ি মাছ বিক্রেতা। যিনি গত বছরের শেষদিকে, করোনা উপসর্গ নিয়ে প্রথম উহানের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি এই প্যান্ডেমিক (Pandemic) থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ জীবন যাপন করছেন।
এখন, অনেকের মনে এই প্রশ্নটি জাগতে পারে যে, আন্তর্জাতিক গবেষণায় এর বাহক যদি বাদুড় কিংবা বনরুই হয় তাহলে চিংড়ি মাছ বিক্রেতার সাথে কি সম্পর্ক! বলে রাখা ভালো, করোনা ভাইরাস অনেক ক্ষুদ্র বা আণুবীক্ষণিক, এটি খুব সহজেই বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে এবং দ্রুত উৎস থেকে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এতো ভাইরাস থাকতে চীন থেকে আসা চায়না ভাইরাস ( মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিজস্ব নামকরণ ! ) কেন এতো বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করলো? এর কারণ খুঁজতে গিয়ে সর্বপ্রথম চীনের বিজ্ঞানীরা এর জিনোটাইপ আবিষ্কার করেন । যার থেকে দেখা যায় এটি একটি RNA ভাইরাস (Ren et al. 2020, Identification of a Novel Coronavirus Casuing Severe Pneumonia in Humans, Chinese Medical Journal), যা নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন।
সার্স-কোভ-২ বা করোনা ভাইরাসটিকে অনেকেই মনে করতে পারেন, যে চীনের তৈরি। ইতোমধ্যে তাঁদের বিজ্ঞানীরা দাবি করছে ভাইরাসটি প্রাকৃতিক। আসলে কি তাই? বিষয়টি নিয়ে ইউ.এস. পেন্টাগন এর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদপত্র “দ্যা গার্ডিয়ান” কে জানানো হয়, ইউ.এস. ইন্টিলিজেন্স এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া সম্বন্ধে ইসরাঈলী গোয়েন্দা সংস্থা “মোসাদ” – এর সাবেক এক কমকর্তার দাবি খতিয়ে দেখেছে এবং ল্যাব টেস্টিং এ তারা এমন কিছু তথ্য পেয়েছে যা ইঙ্গিত করে ভাইরাসটি মনুষ্য সৃষ্ট নয় বরং প্রাকৃতিক ।
এখানেই শেষ নয়! এর পেছনে তারা কিছু ব্যাখ্যাও দিয়েছেন যার প্রথমটি হলো ভাইরাসটির ভর। এর ভর সাধারণত মানব সৃষ্ট কোন ভাইরাসের ভর থেকে বেশ কম। তবে, সঠিক ভর ঠিক কতো তা নিশ্চিত করা হয়নি। এছাড়া, এই ভাইরাসের ব্যাস ৫০ ন্যানোমিটার যা এটিকে প্রকৃতির সৃষ্টি বলেই নির্দেশ করছে। মজার ব্যাপার হলো- চীন ও আমেরিকা দু’দেশের মাঝেই যেহেতু মিত্রতা নেই, তাই আমেরিকা কখনো চীনের পক্ষে সাফাই গাইবেনা! – এটাই স্বাভাবিক।
Related Article :বেশী লবণ খাওয়া দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়
প্রতিটি ভাইরাসের ভেতরে ডি.এন.এ. ও আর.এন.এ.’র মতো বংশীয় নিউক্লিওটাইড থাকে, যা কিনা একটি প্রোটিনের আবরণে মোড়া। এর মধ্যে কিছু প্রোটিন স্পাইকের মতো ভাইরাসের দেহ থেকে বের হয়ে থাকে। করোনাভাইরাসের ভেতরে রয়েছে একটি আর.এন.এ. ফিতা। আর বাইরে S-প্রোটিন নামে একটি স্পাইক রয়েছে। গজালের মতো এই S-প্রোটিন মানবদেহের কোষের বাইরে ACE-2 নামে একটি গ্রাহক প্রোটিনের গ্রাহকের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই গ্রাহক প্রোটিন আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত। যেটি আক্রান্ত হলে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়।
ভাইরাসের স্পাইকের মতো S-প্রোটিনটির মানবকোষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দক্ষতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে তার সাফল্য। বিজ্ঞানীরা এই প্রোটিনের জিনোম কী দিয়ে তৈরি, তা এরই মধ্যে বের করেছেন। এই S-স্পাইক প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আণবিক রূপটি বিজ্ঞানীরা সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
গবেষকেরা আরও বলছেন, যদি এটাকে কৃত্রিম উপায়ে ল্যাবে তৈরি করা হতো, তাহলে তারা এমন একটা ভাইরাসকে কাজ করার জন্য বেছে নিত, যাকে কিনা তারা আগে থেকেই চিনত, যেটা মানুষকে রোগাক্রান্ত করে। যদি তারা SARS-Cov -2 -কে বেছে নিত তাদের জৈবিক অস্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, তাহলে কম্পিউটার সিমুলেশনে SARS-Cov-2 – এর স্পাইকের S প্রোটিনের গঠন সেখান থেকে তারা পাচ্ছেন না, কম্পিউটার তাদের অন্য ধরনের স্পাইক প্রোটিনের গঠন দেখাচ্ছে, যা কিনা SARS-Cov -এর S গজাল থেকে কম দক্ষ।
SARS-Cov-2-এর আণবিক গঠন বাদুড় ও বনরুইয়ের মধ্যে পাওয়া যায় এমন করোনাভাইরাসের সঙ্গে খুব মিল, যাতে মনে হয় এটি খুব সাম্প্রতিক সময়ে চীনে প্রাণি থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে ।বিভিন্ন ভাইরাস বিভিন্ন ধরনের Spike প্রোটিন দিয়ে মানবকোষে আবদ্ধ হয়। আগেই বলা হয়েছে ACE 2 – এর সঙ্গে S কতখানি সফলভাবে যুক্ত হতে পারবে, তার ওপর এই ভাইরাসের সফলতা নির্ভর করছে । এই ক্ষেত্রে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপ্স গবেষণাগারের একটি কাজ বলছে, এই RBD -এর আংটা ACE 2-তে আটকানোর জন্য এতটাই সফল যে (পূর্ববর্তী SARS ভাইরাস থেকে প্রায় ১০ গুণ বেশি) সেটা প্রকৃতিতে অসংখ্য পরিব্যপ্তি বা মিউটেশনের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সবশেষে যে প্রশ্নটি আসে, চীনে ভাইরাসটির উৎপত্তি হলেও সেখানকার মৃতের হার এতোটা কম কেন? ঠিক এইখানেই চমক অপেক্ষা করছিলো সবার জন্য! নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুসারে স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চীনের উহান ও এর পাশ্ববর্তী যতোগুলো মরদেহ পোড়ানোর চুল্লী রয়েছে তা পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে অনেক বেশী সময়, এমনকি রাত দিন ২৪ ঘন্টাই কার্যকর ছিলো যা আগে কখনোই দেখা যায়নি! একটি মরদেহ পোড়ানোর হিসেব অনুসারে জানা যায় যে, সেই সময় উহান সহ এর পাশ্ববর্তী এলাকায় প্রায় ৫০ হাজারের অধিক মানুষের শেষকৃত্য করা হয়। যা কল্পনাতীত সাধারণ সময়ের তুলনায়! সব কিছু শেষে ধোঁয়াশা এখানেই থেকে যায়, চীনে মৃত্যুর আসল সংখ্যাটা তাহলে কতো?
এ এন এম নাঈম / নিজস্ব প্রতিবেদক
করোনাভাইরাস প্রসঙ্গ-
- রক্তের গ্রুপ ‘A’ হলে করোনা ঝুঁকি বেশি, ‘O’ হলে সবচেয়ে কম – বলছে চীনা গবেষণা
- লবণ মেশানো গরম পানি কি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করে ?-না
- করোনা যেভাবে আপনার শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে !(ইন্টারেক্টিভ ডিজাইনসহ)
- ফ্যাক্ট চেক: (মিথ্যা) এক টুকরা লেবুতেই ধ্বংস হবে করোনাভাইরাস
- আমেরিকা বা চীনের ষড়যন্ত্র নয়।করোনাভাইরাস এসেছে প্রকৃতি থেকেই-গবেষণা
- করোনাভাইরাস স্মার্টফোনে প্রায় ৯ দিন জীবিত থাকতে পারে – গবেষণা
- করোনা ভ্যাকসিন বাজারজাত করতে বছর সময় লেগে যেতে পারে