দিনের কর্মব্যস্ত সময়ের সিংহভাগ কম্পিউটারে বা অন্যান্য ডিসপ্লে ডিভাইসে কাজ করলে ভিশনে বা চোখে যে উপসর্গগুলো দেখা দেয়,তার সমষ্টিকে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম বলে। কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোমের উপসর্গ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন- চোখে স্ট্রেইন (চোখে টান টান অনুভূতি হওয়া), মাথা ব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া, চোখের শুষ্কতা, চোখে ঝাপসা দেখা। তবে অনেক ক্ষেত্রে কোমর বা ঘাড় ব্যথার সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন এমন সমস্যার উদ্ভব? আমরা কি তবে প্রযুক্তি ব্যবহার ছেড়ে দেবো? এসকল প্রশ্নের উত্তরে সহজেই বলা যায় কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয় আমরা যখন বারবার পড়ি বা কোন পুরোনো মুভি যখন আমাদের বারংবার দেখানো হয় আমাদের মাঝে বিরক্ত কাজ করা শুরু করে।কিছুটা হেয়ালি হলেও সহজবোধ্য ভাষায় কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোমের উপসর্গ গুলোও কিন্তু আমাদের চোখ এবং মস্তিষ্কের নীরব প্রতিবাদ। আমাদের চোখ যখন একটানা দর্শন এর কাজ করে তখন অক্ষিগোলক অনেকটা শুস্ক হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ল্যাক্রিমাল গ্রন্থির মাধ্যমে ক্ষরিত তরল আমাদের চোখকে আর্দ্র রাখতে সহায়তা করে তা ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনা। এছাড়া ক্রমাগত কাজ করার ফলে চোখের সিলিয়ারি বডি সাসপেন্সরী লিগামেন্ট গুলোতে অনিয়ন্ত্রিত টানের উপলব্ধি হয় যাকে চোখের স্ট্রেইন বলা হয়।
ভিশন স্ট্যাটিকটিস এর একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্ব জুড়েই বহু মানুষ দিন-রাতের বেশির ভাগ সময়ই ডিজিটাল স্ক্রিন-এর দিকে তাকিয়ে কাটান। বিশ্বের ১ বিলিয়ন মানুষের স্বল্প দৃষ্টিশক্তির কারণে চশমার প্রয়োজন। এবং আমেরিকার ৭৫% প্রাপ্তবয়স্কের চোখের সমস্যা রয়েছে ও প্রযুক্তির অবাধ এবং সময়-জ্ঞানহীন ব্যবহারের কারণে এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের কারণ হিসেবে চক্ষুবিশেষজ্ঞরা মূল দায়ী করেছেন মোবাইল স্ক্রিন, টিভি ও কম্পিউটার থেকে উৎসরিত রশ্মি কে। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথের সমীক্ষায় জানা গিয়েছে যে যারা দিনে গড়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা কম্পিউটারে কাজ করেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৯০% এই সমস্যায় ভুগছেন। এদের মধ্যে আবার বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর।
ছেলেবেলায় আমরা যখন খুব কাছ থেকে টেলিভিশন দেখতাম তখন বাড়ির বড়রা হামেশাই বলে থাকতেন, “খুব কাছে থেকে টেলিভশন দেখো না, তা হলে চোখ খারাপ হয়ে যাবে।” ঠিক একই কথাই এখন কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোমের থেকে প্রতিকার পাওয়ার একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে- খুব কাছে থেকে কম্পিউটারে কাজ করা যাবেনা।
সিভিএস’ বা কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম এই ব্যাপারটি খুব গুরুতর না হলেও ক্রমাগত সমস্যায় দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। চিকিৎসকদের পরামর্শে কয়েকটা নিয়ম মেনে প্রযুক্তি ব্যাবহার করলেই কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোমের হাত এড়ানো যায়।
চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, টানা ২০ মিনিট কম্পিউটারে কাজ করার পর ২০ সেকেন্ডের জন্যে চোখকে স্ক্রিন থেকে সরিয়ে নিতে হবে।এ ক্ষেত্রে সবচাইতে কার্যকরী হলো ২০– ২০–২০ নিয়ম মেনে চলা। অন্তত পক্ষে ২০ মিনিট পর পর যদি চোখকে বিশ্রাম দেওয়া যায় তা হলে উপকার হবে চোখেরই।এক্ষেত্রে কোন কিছুর দিকে তাকানো যায়,যেটি হতে পারে ঘরোয়া গাছ কিংবা প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট নয় এমন কিছু। খুব ভাল হয় উঠে দাঁড়িয়ে দু-তিন মিনিট জানালার পাশ থেকে ঘুরে এলে। সবুজের দিকে তাকালে চোখের অনেকটা আরাম হয়।কাজ করার স্থানের আশেপাশের দেয়াল সবুজ রঙের হলে এক্ষেত্রে সবচাইতে বেশী ভালো হয়।
কাজ করার সময় টানা কাজ না করে প্রতি ঘন্টায় বা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর পাওয়ার ন্যাপ নেওয়া যা চোখের সাথে সাথে মস্তিষ্ককেও বিশ্রাম দিবে। চিকিৎসকদের মতে পাওয়ার ন্যাপ হলো অনেকটা এনার্জি বুস্টার এর মতোন কাজ করে থাকে যা একজন কর্মব্যস্ত মানুষকে শুধু তার চোখের শ্রান্তিই প্রদান করেনা সেই সাথে আরো দক্ষভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।
কম্পিউটারে টেক্সট সাইজ কে সাধারণ আকারের চেয়ে বড় করে দিতে হবে। এর ফলে চোখের উপর আসা বাড়তি চাপ কমে গিয়ে সিভিএস এর প্রকোপ অনেকটুকুই কমিয়ে দেবে।
আশেপাশের আলোর উৎস থেকে আসা আলো অনেকসময় আমাদের চোখের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাই যথাসম্ভব আলোর উৎসের পরিমাণ হ্রাস করতে হবে।
চক্ষুবিশেষজ্ঞদের মতে সব ধরনের কম্পিউটার মনিটরের মাঝে সমতল মনিটর (Flat Monitor) এ ভিশন সিন্ড্রোম হওয়ার প্রবণতা বহুলাংশে কম। তাই সর্বদা এমন ধরনের মনিটর নির্বাচন করতে হবে কাজ করার জন্য।
কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোমের পিছনে কয়েকটি কারণের মাঝে একটি হলো চোখের পলক না ফেলার কারণে মণি শুকিয়ে যাওয়া। চোখের পাতার তলায় থাকে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম গ্রন্থি। পলক পড়লে এর থেকে বিশেষ ধরনের পানি বের হয়। এটি চোখের মণিকে ভিজিয়ে রাখে। চোখ ভাল রাখতে ভিজে থাকা দরকার। কিন্তু কম্পিউটার বা মোবাইলে কাজ বা চ্যাট করার সময় বেশিরভাগ মানুষই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক পড়ে না। তাই এই তরল বের হতে পারে না, এর ফলে চোখ যায় শুকিয়ে।তাই অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্রতি মিনিটে অন্তত ১২ বার চোখের পলক পড়ে। যা চোখকে অনেকাংশে শুস্কতার হাত থেকে রক্ষা করে।
চক্ষু সীমা থেকে ৪-৫ ইঞ্চি নীচে রাখতে হবে সবসময় মনিটর কে। যা স্ক্রিন থেকে নিসৃত রস্মির সরাসরি প্রকোপ থেকে চোখকে রক্ষা করে।
কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম (সিভিএস)-এর প্রধান কারণ নাগাড়ে এক দিকে ঘাড় কাত করে বা সোজা করে রাখা। এর ফলে ঘাড়ের পেশিতে রক্ত চলাচল কমে শক্ত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে ঘাড়ে-মাথায় ব্যথা করে। তবে এই সমস্যা শুধু যে ঘাড় মাথা আর চোখেই সীমাবদ্ধ তা কিন্ত নয়। ধীরে ধীরে তা পিঠে, কাঁধে আর হাতেও স্থানান্তরিত হয়। এ সবের মূলেই কিন্তু এক ভঙ্গিমায় অনেক্ষণ ধরে বসে থাকা। তাই দীর্ঘক্ষণ একস্থানে বসে না থেকে মাঝেমধ্যে ঘরের ছোটোখাটো কাজ করে আসা যেতে পারে। কিংবা করা যেতে পারে ইয়োগা।
কম্পিউটার মনিটরের রিডিং মুড অপশন রইলে তা অবশ্যই ব্যবহার করা। যা চোখের জন্য স্বস্তিদায়ক পরিবেশ সৃস্টি করতে সক্ষম
অফিসে কাজ করার স্থান যদি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের কাছাকাছি থাকে এর ঠান্ডা বাতাসে চোখ আরও শুকিয়ে যায়।
চোখ যদি বেশী শুস্ক হয়ে পড়ে তবে কিছুক্ষণ পর পর চোখে পানি দিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে আই ড্রপ আইটোন ও ব্যবহার করা যেতে পারে। চোখে পানি দিয়ে এলেও ভাল হয়। প্রয়োজন হলে আইটোন বা রিফ্রেশ জাতীয় ড্রপ ব্যবহার করতে হবে।
কাজ করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কম্পিউটার ও ব্যবহারকারীর মধ্যবর্তী দূরত্ব ২০-২৮ ইঞ্চির মাঝে হয়।
কম্পিউটার ভিশন সিন্ড্রোম এড়াতে যাদের চশমা ব্যবহার করতে হয় তাঁদের অবশ্যই চশমা পরিধান সাপেক্ষেই কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে কাজ করতে হবে। নয়তো চোখের জটিলতা কলেবরে আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। এবং উপসর্গ দেখা দেওয়া সাপেক্ষে অবশ্যই নিকটস্থ চক্ষু বিশেষজ্ঞের সরাপন্ন হতে হবে।
এ এন এম নাঈম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ
3.https://www.aoa.org/healthy-
4.https://www.fairview.org/
5.https://www.cedars-sinai.