এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর কথা আমরা সবাই জানি। এর উপকারিতার সাথে সবচেয়ে যে বিষয়টি আলোচনায় থাকে সেটা হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভয়াবহতা। এই ভয়াবহতার শঙ্কা থেকেই নিজের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে অনুশোচনায় গুগলের চাকরি ছাড়লেন এআই গডফাদার খ্যাত জেফ্রি হিন্টন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বর্তমানে এমন উন্নত হয়েছে যে এটি যেকোনো পণ্যকে কীভাবে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলা যায় এবং জনসাধারণের কাছে সহজে পৌঁছানো যায় তার জন্য উপদেশ প্রদান করতে সক্ষম, আর এর সবই সম্ভব হয়েছে জেফ্রি হিন্টনের নিউরাল নেটওয়ার্ক নিয়ে অগ্রগামী কাজের ফলাফল হিসেবে। টেক জায়ান্টের এআই বিকাশের প্রচেষ্টায় তিনি এক দশক ধরে গুগলে পার্ট টাইম জবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এআই এর বিকাশকে আরো এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি আশংকা প্রকাশ করেছেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন যেমন মানবসভ্যতার জন্য অকল্পনীয় উন্নতির কারণ হতে পারে, ঠিক তেমনি হুমকির প্রধান কারণও হতে পারে। ভুয়া ছবি তৈরীর মাধ্যমে গুজব ছড়ানোসহ অপরাধের জগৎ বিস্তৃত হতে পারে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে। হিন্টন দাবি করছেন, তিনি যে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন তার পরিণতি ভয়ঙ্কর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ভবিষ্যতে তৈরি হতে চলা খারাপ পরিস্থিতি নিয়েও শঙ্কিত তিনি। তাই হিন্টন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপকারিতা এবং ঝুঁকি নিয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলার জন্য পদত্যাগ করেছেন গুগল থেকে।
মার্চ মাসের শেষের দিকে, টেক কোম্পানির কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ল্যাবগুলো (যেখানে এআই এর মতো কিছু শক্তিশালী যন্ত্রকে ট্রেনিং দেয়া হয়) অন্তত ৬ মাসের জন্য বন্ধ রাখার অনুরোধে স্বাক্ষর করে একটি চিঠি লিখেন। চিঠিটির মূল উদ্দেশ্য ছিলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হতে সমাজ ও মানবতাকে রক্ষা করা। চিঠিটি ইলন মাস্কের অলাভজনক OpenAI GPT-4 ঘোষণা করার দুই সপ্তাহ পরেই প্রকাশ করে ফিউচার অফ লাইফ ইনস্টিটিউট। OpenAI GPT-4 হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরো শক্তিশালী একটি সংস্করণ, যা ChatGPT কে আরো ক্ষমতা লাভে সহায়তা করে।
এআই-এর নিজস্বভাবে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে। তাই এর ফলে প্রযুক্তিক্ষেত্রে যুক্ত সাধারণ কর্মী এবং মেধা ও বুদ্ধি খরচ করে জীবিকা নির্বাহ করা কর্মীদের চাকরি হারানোর শঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এমনকি মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। ফলে বিশ্বব্যাপী ধীরে ধীরে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মী ছাঁটাই বাড়তে পারে। চাকরির অভাব দেখা দিতে পারে।
আর যেহেতু এআই-এর মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, সেক্ষেত্রে একসময় এটি মানুষের প্রজাতিকে ধ্বংস করে নিজেদের কর্তৃত্ব বিস্তার করতে পারে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
জেফ্রি হিন্টনের মতে, কিছু মানুষ বিশ্বাস করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চেয়েও বেশি সূক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারে, তিনিও একই ধারণা পোষণ করতেন। তবে তিনি মনে করতেন এমনটা হতে কমপক্ষে ৩০ বা ৫০ বছরের মতো সময় লেগে যাবে। কিন্তু বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্রুত উন্নয়ন তার এই ধারণাকে বদলে দিতে বাধ্য করেছে।
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে হিন্টন জানিয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার করে চলেছে সমাজের একাংশ। ভুয়া ছবি এবং খবর তৈরিতে যেভাবে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হিন্টন।
তিনি আরও বলেছেন যে, টেক জায়ান্টদের মধ্যে প্রতিযোগিতা কোম্পানিগুলিকে বিপজ্জনক গতিতে নতুন এআই প্রযুক্তি প্রকাশ করতে, চাকরির ঝুঁকি এবং ভুল তথ্য ছড়াতে চাপ দিচ্ছে।
ইলন মাস্ক এবং অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ ওজনিয়াক সহ এক হাজার জনেরও অধিক লোকের স্বাক্ষরিত চিঠিতে চ্যাটজিপিটি-এর ব্যবহৃত প্রযুক্তির আরও শক্তিশালী সংস্করণ জিপিটি-৪ প্রকাশের জন্য প্ররোচনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
এআই এর গডফাদার খ্যাত হিন্টন সেই সময় সেই চিঠিতে স্বাক্ষর করেননি। তিনি বলেছিলেন যে, বিজ্ঞানীরা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন কিনা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এটিকে আরও বাড়ানো উচিত নয়।
তবে শুধু জেফ্রি হিন্টনই যে প্রথম এআই কে লাল পতাকা দেখিয়েছেন তা কিন্তু নয়, বরং গুগলে কর্মরত আরো একজন প্রকৌশলী এআই এর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, অপ্রকাশিত একটি এআই সিস্টেম কর্মসংস্থান এবং ডাটা সুরক্ষা নীতি লঙ্ঘন করেছে, একইসাথে এটি ধীরে ধীরে সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। তবে এআই সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রকৌশলীরা তার এই অভিযোগকে নাকচ করে দিয়েছিলো এবং গুগল হতে তাকে জুলাই মাসে বরখাস্ত করা হয়েছিলো।
এআই এর উন্নতি যেমন অনেক কাজকে সহজ করে দিয়েছে, তেমনি এর কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। এআই এর এই উন্নতি অব্যাহত রাখা উচিত নাকি বন্ধ করা উচিত তা এখনো একটি বিতর্কের বিষয়। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
তথ্যসূত্রঃ সায়েন্স অ্যালার্ট
নিজস্ব প্রতিবেদক / শেখ শাহরিয়ার হোসেন