বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে সম্মান জনক পুরস্কারের কথা বললেই চট করে একটা নামই মাথায় আসে, Nobel Prize বা নোবেল পুরস্কার। গত কিছুদিন আগেই যেই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিজ্ঞানের জগতে অবদান রাখা গুণী ব্যক্তিরা। শুনতে অবাক লাগলেও আসল নোবেল পুরস্কারের বাইরে আরও একটি নোবেল পুরস্কার আছে! এই পুরস্কারের নাম ‘ইগ নোবেল পুরস্কার’।
এই পুরস্কারটাও বিজ্ঞান নিয়েই। তবে অন্যসব পুরস্কারের চেয়ে এই পুরস্কারটা কিছুটা ভিন্ন। এটি মূলত নোবেল পুরস্কারের প্যারোডি। ইগনোবল (ল্যাটিন ভাষার যার অর্থ দাঁড়ায় ‘নোবেল নয়’) থেকে ইগ নোবেল নাম দেয়া হয়েছে।
ইগ নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় বিজ্ঞানের এমন সব গবেষণার উপর যেগুলো প্রথমবার শুনলে মানুষের হাসি আসবে। কিন্তু পরে ঠিকই ভাবাবে। এটি একটি ব্যঙ্গাত্মক পুরস্কার যা ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দশটি অস্বাভাবিক বা তুচ্ছ সাফল্য উদযাপনের জন্য প্রদান করা হয়। মোটেও কাউকে ঠাট্টা বা বিদ্রুপ করার উদ্দেশ্যে এই নোবেল দেয়া হয় না। এর উদ্দেশ্যই হলো সেসব অর্জনকে সম্মান করা যা প্রথমে মানুষকে হাসায় এবং তারপরে তাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভার্চুয়ালি ইগ নোবেল পুরস্কারের ৩৩তম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিজয়ীরা প্রত্যেকে ১০ ট্রিলিয়ন জিম্বাবুয়ে ডলার এবং ‘ইগ সিডো কোলা’ এর একটি প্যাকেজ পেয়েছেন।
২২ টি দেশের বিজ্ঞানীরা এবার ইগ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচজন, যুক্তরাজ্যের চারজন এবং চীনের তিনজন গবেষক আছেন।
মানুষের উভয় নাকের ছিদ্রে কী সমান সংখ্যক লোম থাকে? ভূতাত্ত্বিকরা কেন পাথর চাটেন?
এরকম নানান অদ্ভুত বিষয়ের উপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জিতে নিয়েছেন ইগ নোবেল পুরস্কার। ১০ টি ভিন্ন বিভাগে তারা এই পুরস্কার পেয়েছেন।
রসায়ন এবং ভূতত্ত্ব
ভূতত্ত্ববিদ বা জীবাশ্মবীদদের মধ্যে পাথর চেটে দেখার একটা আচরণ প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়।
এমনটা তারা কেন করেন?
জান জালাসিউইচ নামের এক গবেষক এর ব্যাখ্যা দিয়ে জিতে নিয়েছেন ইগ নোবেল পুরস্কার। তার ব্যাখ্যা অনুসারে বিশেষ ধরনের শিলা চেটে তা থেকে বিশেষ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পেয়ে তা শনাক্ত করা যায়। তার গবেষণাপত্রে তিনি আগ্নেয় উপত্যকার স্থানীয় শিলা, খনিজ পদার্থ ও জীবাশ্মের স্বাদের বর্ণনা দিয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, পোড়া জীবাশ্ম এবং কয়লার বিট সামান্য তিক্ত স্বাদ যুক্ত হয়। আবার মার্কাসাইট (একটি বিশেষ ধরনের খনিজ) এর মধ্যে একটি ‘এসিডিক মসলাদার স্বাদ’ রয়েছে।
লিটারেচার
দেজা ভ্যু সম্পর্কে প্রায় সকলেরই জানা আছে। দেজা ভ্যু হলো নতুন কোনো বিষয়কে হঠাৎ করে পুরাতন মনে হওয়া। কেউ হয়তো কখনো কোনো একটি কাজ কখনোই করেননি বা নির্দিষ্ট একটি ঘটনার সম্মুখীন কখনোই হননি তারপরও তার মনে হয় কেন যেন পূর্বে তিনি এই কাজটি হয়তো করেছেন কিংবা তার সাথে ঘটনাটি ঘটেছে।
দেজা ভ্যু এর সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা হলো ‘জামাইস ভ্যু’। যখন কোন ব্যক্তি পূর্বে করা কোনো পরিচিত কাজ বা ঘটনাকে নতুন মনে করেন। তারা মনে করেন আগে তিনি এটি কখনো করেননি বা এই ঘটনা তার সাথে ঘটে নি তখন তাকে ‘জামাইস ভ্যু’ বলে।
ক্রিস মলিন, নিকল বেল ও তাঁদের দল এই জামাইস ভ্যু নিয়ে একটি মজার পরীক্ষা চালিয়েছেন। সেটা নিয়ে একটি রিসার্চ আর্টিকেলও প্রকাশ করেছেন। সেই হিসেবে এটিকে লিটারেচার এর কাতারে ফেলা হয়েছে।
তাদের ধারণা ছিল যে জামাইস ভ্যু পরিস্থিতি ইচ্ছে করে তৈরি করা সম্ভব। তাই তারা এই পরীক্ষার জন্য লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছেন। তাদের সামনে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ ঘনঘন উচ্চারণ করা হয় এবং হঠাৎ থামিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া বারংবার চলতে থাকে।
প্রায় এক মিনিট এই কাজ করার পর তারা Semantic satiation এর শিকার হন। এটি এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা যেখানে পুনরাবৃত্তির ফলে একটি শব্দ বা বাক্যাংশের অর্থ সাময়িকভাবে শ্রোতা ভুলে যান। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেছে।
কারো কারো সংবেদন এতটাই প্রবল ছিল যে সে শব্দগুলোর দিকে সরাসরি তাকিয়ে ও কিছু সময়ের জন্য তারা শব্দগুলোকে বুঝতে পারছিলেন না। তাদের কাছে এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি শব্দ হিসেবে ধরা দেয়।
যন্ত্র প্রকৌশল বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
রাইস ইউনিভার্সিটির স্নাতকের ছাত্র “ফায়ে ইয়াপ” একদিন ল্যাবের হলওয়েতে একটি মৃত কোঁকড়ানো মাকড়সা খুঁজে পান। তিনি চিন্তা করে দেখেন মৃত মাকড়সার মৃতদেহকে ছোট ছোট ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশ তোলা এবং চালনা করার জন্য বায়ুচালিত গ্রিপার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইয়াপ এবং তার সহকর্মীরা উপদেষ্টা ড্যানিয়েল প্রেস্টন সহ ঠিক তাই করেছিলেন। তারা একটি মৃত ওলফ স্পাইডারকে একটি আঁকড়ে ধরার মতো ডিভাইসে রূপান্তরিত করেছেন। তার এই ছোট্ট উদ্ভাবনের নাম ‘নেক্রোবোটিক্স’। এটি একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে যা রোবটিক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ নতুন উদ্ভাবন এর সুযোগ করে দিবে।
মাকড়সার প্রোসোমাতে (Cephalothorax) অভ্যন্তরীণ ভাল্ব রয়েছে যার সাহায্যে মাকড়সা প্রতিটি পা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাকড়সা মারা গেলে পা গুলো একক নিয়ন্ত্রণ হারায় অর্থাৎ সবগুলোকে একসাথে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ তৈরি হয়। মৃত মাকড়সার প্রসোমায় সুঁই সংযুক্ত করে বায়ুর চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পা গুলোকে ব্যবহার করে কোন জিনিস আঁকড়ে ধরা যায়।
মেডিসিন
একদল বিজ্ঞানী এরিয়াটা (এমন একটি রোগ যাতে শুধু মাথারই নয়, বরং শরীরের যে কোন অংশের চুল ঝরে পড়ে) নামক এক রোগের উপর গবেষণা চালানোর সময় একটি মজার তথ্য উঠে আসে। ক্রিস্টিন ফাম, বোবাক হেদায়াতি, কিয়ানা হাশেমি, এলা সুকা, তিয়ানা মামাঘনি, মার্গিট জুহাস, জেমি উইকেনহেইজার, এবং নাতাশা মেসিনকোভস্কা মিলে এই পরীক্ষাটি চালান।
পরীক্ষাটিতে একজন ব্যক্তির দুটি নাকের প্রতিটিতে সমান সংখ্যক চুল আছে কিনা তা জানার জন্য মৃতদেহ ব্যবহার করা হয়। তারা ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল স্কুল থেকে ২০টি মৃতদেহ (দশজন পুরুষ এবং দশজন মহিলা) সংগ্রহ করেন।
প্রতিটি নাসারন্ধ্রে শুধুমাত্র চুলই গণনা করা হয়নি পাশাপাশি পার্শ্বীয় এবং নিচের নাসারন্ধ্রে চুলের বৃদ্ধির দূরত্ব নির্ধারণের জন্য একটি পরিমাপ টেপ ব্যবহার করেছিল। ফলাফলে ওঠে আসে, নাকের প্রতি ছিদ্রে গড় চুলের সংখ্যা ১২০ থেকে ১২২ এর মধ্যে, এবং নাকের লোম সাধারণত ০.৮১ থেকে ১.০৩৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়।
যোগাযোগ
স্পেনের লা লেগুনার বাসিন্দাদের একটি দল আছে, যারা পশ্চাদগামী কথা বলতে পারদর্শী (শব্দ উল্টানো)। উদাহরণস্বরূপ, তারা বুয়েনোস নচেসের পরিবর্তে নাসবু চেসনো বলে। তাদের এই ভাষাকে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির প্রচেষ্টা এখনো সফল হয়নি।
তাদের এই উল্টোভাবে কথা বলার বিশেষ দক্ষতা নিয়ে কাজ করেছেন মারিয়া জোসে টরেস-প্রিওরিস, ডায়ানা লোপেজ-বারোসো ও তাদের দল। তাদের গবেষণাপত্রে তারা লিখেছেন, পশ্চাদগামী বক্তৃতা শব্দ, ছদ্মশব্দ এমনকি বাক্যগুলোকে দ্রুত বিপরীত করার একটি অসাধারণ ক্ষমতা গঠন করে, যার জন্য তাদের পরিচয় বজায় রেখে ধ্বনিগুলোকে পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। তারা এই বিশেষ দক্ষতা প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি করেছে এবং সময়ের সাথে রপ্ত করেছে।
গবেষণার জন্যে তারা দু’জন পুরুষের উপর পর্যবেক্ষণ করেছেন যারা এরূপ পশ্চাদগামী কথা বলতে পারদর্শী। গবেষণায় দেখা গেছে, এই দুই পুরুষের মস্তিষ্কের ইমেজিং ধূসর পদার্থের (গ্রে ম্যাটার) পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভাষার সাথে যুক্ত মস্তিষ্কের মূল অংশগুলোতে কার্যকরী সংযোগ (হোয়াইট ম্যাটার) উন্নত হয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো মানুষের ভাষা ব্যবহারের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ফলে তারা Phoneme (ধ্বনির সূক্ষ্মতম মৌলিক অংশকে বা একককে বলা হয় ধ্বনিমূল বা phoneme) এর পশ্চাৎ ব্যবহারে অধিক সক্ষম।
এমনি আরো ক্ষেত্র যেমন পুষ্টি, শিক্ষা, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদিতে অবদান রাখার কারণেও দেয়া হয়েছে ইগ নোবেল পুরস্কার। সেসব উদ্ভাবন গুলো জানতে পড়ুন ইগ নোবেল পুরস্কার নিয়ে আমাদের ২য় পর্ব।
জুম্মান আল সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক