চেরনোবিল কী? একটি শহরের নাম? হ্যাঁ, তবে শুধুই একটি শহর নয়! চেরনোবিল একটি পারমাণবিক বিপর্যয়ের নাম! এক মহামারীর নাম। যে মহামারী আজও গ্রাস করে আছে প্রায় ২৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা। যে মহামারীর প্রভাবে আজও জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু।
তেজস্ক্রিয়তা যে ভয়াবহ তা মাদাম কুরি তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর মাধ্যমে জানান দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভয়াবহতা যে এতটা তীব্র তা জানা ছিলো না বিশ্ববাসীর।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান ইউক্রেনের পৃপিয়াত অঞ্চলের একটি শহর চেরনোবিল।
এখানেই ১৯৭৭ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল চারটি RBMK রিয়্যাক্টরবিশিষ্ট Vladimir I. Lenin Nuclear Power Plant– এর। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রেই ১৯৮৬ সালের ২৬ শে এপ্রিল মধ্যরাতে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
যে দুর্ঘটনায় সরকারি হিসেবে মারা যায় ৩১ জন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় প্রায় ৩০০০-৮০০০ মানুষ। আজ পর্যন্তও সেখানে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
তবে এই ২৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক বন এবং বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল। কিন্তু সেখানকার তেজস্ক্রিয়তা মানুষের জন্য বিপজ্জনক হলে কীভাবে সেখানে বন্যপ্রানী এবং গাছপালা টিকে আছে?
দুর্ঘটনার তিন বছরের মাথায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায়ও গাছের নতুন চারা গজাতে দেখা যায়। বিপর্যয়ের পরপরই সকল স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যেতে শুরু করে।
কিন্তু গাছপালার ক্ষেত্রে কেন তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব স্থিতিশীল?
এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রথমে জানতে হবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ কিভাবে জীবন্ত কোষকে প্রভাবিত করে। চেরনোবিল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হতো ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপ যা খুবই উচ্চশক্তিসম্পন্ন। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ কোষের মূল কাঠামো ধ্বংস করে ফেলে এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাসায়নিক তৈরি করে। কোষের যে কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা প্রতিস্থাপন করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ডিএনএ ব্যাতিক্রম।
বিকিরণের ফলে ডিএনএ গলে যায় এবং কোষ মারা যায়। বিকিরণের মাত্রা যত বেশি হয় কোষ তত দ্রুত গলতে থাকে। তবে দীর্ঘদিন বিকিরণের মধ্যে থাকলে তা ক্যান্সার কোষ তৈরিতে ভূমিকা রাখে বিশেষ করে থাইরয়েড ক্যান্সারের হার মারাত্মক।
এভাবে কোষ ধ্বংস হতে হতে এক সময় প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
প্রাণীদেহের ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তা ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কারণ প্রাণীদেহ বিশেষ করে মানবদেহ খুবই জটিল অঙ্গ। মানবদেহকে একটি যন্ত্রের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় প্রতিটি কোষ-অঙ্গাণুর আলাদা আলাদা কাজ রয়েছে এবং মানবদেহকে বাঁচিয়ে রাখতে এরা একে অপরকে সহযোগিতা করে। হৃদপিণ্ড বা ফুসফুস ছাড়া কখনোই একটি জীবন্ত মানবদেহ কল্পনা করা যায় না।
কিন্তু গাছের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। গাছ মানবদেহের মতো এতো জটিলভাবে বেড়ে ওঠে না। গাছ জৈবিকভাবে বেঁচে থাকে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান মাটি এবং ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সংগ্রহ করে। আবার গাছ নিজের প্রয়োজনে যে কোনো অংশে নিজের মতো করে কোষ বা টিস্যু গঠন করতে পারে যেটা প্রানীদেহে সম্ভব নয়। এর মানে এটাই যে গাছ তার ক্ষতিগ্রস্ত কোষ খুব দ্রুতই প্রতিস্থাপন করতে পারে যেটা কোনো প্রাণী পারে না।
হোক সেই ক্ষতিগ্রস্ত অংশ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ কিংবা কোনো কিছুর আঘাত।
আবার ক্যান্সার কোষ মানবদেহে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পরে কিন্তু উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোষ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। মজার ব্যাপার হলো, এই বিকিরিত অঞ্চলের গাছপালাগুলো নিজেদের ডিএনএ-কে রক্ষা করার জন্য গাছের স্বাভাবিক রাসায়নিক পদার্থের বাইরে আরো কিছু রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে যা এদেরকে তেজস্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে আরও প্রতিরোধী করে তোলে৷ গাছের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা হয়তোবা অভিযোজনের সর্বোচ্চ চেষ্টার ফল।
চেরনোবিলের আশেপাশে এখন গাছ ও পশুপাখির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে যার পরিমাণ বিপর্যয়ের আগে থেকে বেশি। এতে বোঝা যায় চেরনোবিলে জীবন আস্তে আস্তে সমৃদ্ধ হচ্ছে। তেজস্ক্রিয়তা বিভিন্ন প্রজাতির গাছের উপর প্রভাব ফেলেছে এবং প্রচুর গাছ মারাও গিয়েছে।
কিন্তু চেরনোবিলে প্রকৃতির এই পুনরুত্থান আপনাকে অবাক করবেই। সর্বোপরি পরিবেশের উপর আমাদের যে ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে চেরনোবিল তা প্রমাণ করে।
তবুও এই দুর্ঘটনা স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের জন্য লাভজনকই বলা চলে। কারণ এর মাধ্যমে মানুষ চেরনোবিল থেকে সরে গিয়ে প্রকৃতিকে চেরনোবিলে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছে।