পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এর বিশ্বের সবচেয়ে বড় জেনেটিক গবেষণা জিনোমের মধ্যে ৯৫ টি অঞ্চল খুঁজে বের করেছে যা PTSD এর সম্পর্কিত, যার মধ্যে ৮০ টি পূর্বে অজানা ছিল। PTSD হল একটি মানসিক অবস্থা, যা সাধারণত ট্রমাটিক বা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে আসা ব্যক্তির মধ্যে হয়ে থাকে। অনেকের জন্য, PTSD একটি দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক অবস্থায় চলে যেতে পারে।
ক্রনিক অবস্থাটি সাধারণ জনসংখ্যার প্রায় 10% এবং মারাত্মক কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে যাওয়া (যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া এবং হামলার শিকার) জনসংখ্যার 20% থেকে 30% এর মধ্যে দেখা যায়। ২০১৭ এবং ২০১৯ সালে সায়েন্স ডিরেক্ট-এ প্রকাশিত জেনেটিক গবেষণাদ্বয় অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির জেনেটিক্স PTSD-এর উপর একটি বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। জেনেটিক্স আসক্তি বা ডিপ্রেশনেও প্রভাব ফেলে। যাইহোক, এই গবেষণাদ্বয় শুধুমাত্র কিছু জটিল চিত্র প্রকাশ করেছিল। এই চিত্র দেখে বুঝার উপায় নেই যে, PTSD-এর পিছনে কি কিছু নির্দিষ্ট জিন নাকি শত শত জিন জড়িত।
১৮ এপ্রিল,২০২৪ এ নিভারগেল্ট (Nievergelt) এবং তার সহকর্মীদের দ্বারা নেচার জেনেটিক্স জার্নালে প্রকাশিত নতুন গবেষণায়, সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১ মিলিয়নেরও বেশি লোকের জেনেটিক ডেটা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এসব জনসংখ্যার প্রায় ১৩% এর PTSD রয়েছে এবং ৮৭% এর নেই। গবেষকরা একটি জিনোম-ওয়াইড অ্যাসোসিয়েশন স্টাডি (GWAS) পরিচালনা করতে এই বিশাল ডেটা সংগ্রহ ব্যবহার করেছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন জেনেটিক ডেটার এই ভাণ্ডারটি শেষ পর্যন্ত PTSD-এর জন্য নতুন থেরাপির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
GWAS হলো জিনোম সিকুয়েন্সিংয়ের একটি পদ্ধতি যা বিজ্ঞানীদের জিন এর সাথে সম্পর্কিত বিশেষ রোগ নির্ণয় করতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয় এবং তাদের মধ্যে খুবই ক্ষুদ্র জেনেটিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা হয়। তারপর সম্পূর্ণ জনসংখ্যার পরিসংখ্যান বিবেচনা করে রোগ নির্ণয় করা হয়। একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা PTSD-এর পিছনে জেনেটিক কারণগুলির একটি বিস্তারিত জেনেটিক ম্যাপ (যার মাধ্যমে ডিএনএ এর কোথায় কি আছে তা খুঁজে পাওয়া যায়) তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
ম্যাসাচুসেটসের ম্যাকলিন হাসপাতালের মনোরোগ বিদ্যার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং প্রধান ড. কেরি রেসলার (Dr. Kerry Ressler) বলেছেন,
“২০১৮ সালে প্রকাশিত আমাদের প্রথম পেপারের কাজের জন্য জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০,০০০ লোক।কিন্তু দ্রুতই, মেরিন কর্পস মিলিয়ন ভেটেরান্স প্রোগ্রাম, ইউ.কে. বায়োব্যাঙ্ক এবং 23andMe-এর সাথে কাজ করার কারণে গবেষণার জন্য জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। যার ফলে ২০,০০০ থেকে এক মিলিয়ন জনসংখ্যার ডেটা পেয়েছি।”
বিশাল জনসংখ্যার পাশাপাশি এই গবেষণাটি অন্য কারণে একটু অনন্য। কারণ এটিতে ৫৮,০০০ জনসংখ্যা নন-ইউরোপিয়ান বংশোদ্ভূত ছিল যেখানে বিগত গবেষণাগুলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে শ্বেতাঙ্গদের উপর করা হয়েছিল। এ গবেষণায় জিনোমের মধ্যে মোট ৯৫ টি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ১৫ টি পূর্ববর্তী গবেষণার ফলাফল কে নিশ্চিত করেছে। অনেকগুলো অঞ্চল PTSD এবং ডিপ্রেশন উভয়ের মধ্যে দেখা যায়, কিন্তু কিছু শুধুমাত্র PTSD-এর জন্য দেখা যায়।
বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলগুলোর কাছাকাছি ৪৩ টি জিন শনাক্ত করেছেন যা পরবর্তীতে চিকিৎসায় ভূমিকা রাখতে পারে। পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে, মস্তিষ্কের সার্কিটগুলো PTSD-তে একটি বড় ভূমিকা পালন করে; এগুলো অ্যামিগডালা (amygdala- ভয় কেন্দ্র নামে পরিচিত যা আবেগ ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে) এবং হিপ্পোক্যাম্পাসে (hippocampus- যা মেমোরি ও লার্নিং এ সাহায্য করে) অবস্থান করে যা হুমকির প্রতি সাড়া প্রদান করে। এই গবেষণায় CRHR1 এবং FOXP2 নামক জিনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা PTSD ঘটানোতে ভূমিকা রাখে।
শুধু তাই নয়, লিঙ্গভেদেও PSTD-এর ভিন্নতা দেখা যায়। এটিই PSTD রিলেটেড প্রথম গবেষণা, যেখানে X ক্রোমোজোমের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। গবেষণার ফলাফলে ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর জিন খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থান করে। ফলস্বরূপ, পুরুষদের তুলনায় নারীদের PSTD হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। ভবিষ্যতে, গবেষণা মহল জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় ব্যক্তিদের, বিশেষ করে আফ্রিকার ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার আশা করছে।
রেসলার বলেন,
“আফ্রিকার সমস্ত যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা উক্ত গবেষণায় উঠে আসেনি। দুর্ভাগ্যবশত ঐ অঞ্চলের জনগণের বিশাল একটা অংশ ট্রমাটাইজড অবস্থায় রয়েছে। আমাদের পরবর্তী টার্গেট হল আফ্রিকার ঐ অঞ্চলের জনসংখ্যা।”
বিজ্ঞানীরা রোগীদের মস্তিষ্কের টিস্যুতে জিনের কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রাপ্ত ডেটার সাথে তাদের জেনেটিক ডেটা একীভূত করার আশা রাখছেন, যাতে তারা জানতে পারে যে, এই নতুন চিহ্নিত জিনগুলি কোথায় অত্যন্ত সক্রিয় এবং কীভাবে তাদের চিকিৎসার মাধ্যমে দূর করা যেতে পারে।
রিয়াজুল ইসলাম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: লাইভসায়েন্স, সায়েন্সডেইলি