OCD (Obsessive Compulsive Disorder) এতটাই স্বাভাবিক ব্যাপার যে এটাকে আমরা অনেক সময় রোগ হিসেবে ভাবতেই চাই না। উদাহরণ দিয়ে বললে বিষয়টি আরো পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারবেন। আমাদের পরিচিত এমন অনেকেই আছেন যারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অন্যদের চাইতে বেশি খুঁতখুঁতে। যেমন: কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়া, নিজের জিনিসপত্র বারবার পরিষ্কার করা, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস একটা নির্দিষ্ট ছকে গুছিয়ে রাখা এবং না থাকলে তীব্র বিরক্তি, রাগ প্রকাশ করা, দরজার লক, ফ্যান-লাইটের সুইচ, পানির কল, গ্যাসের লাইন অন-অফ আছে কিনা বারবার চেক করা।
এ রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা অনুন্নত দেশের তুলনায় উন্নত দেশে অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, OCD বিশ্বের সবচেয়ে মানব নিষ্ক্রিয়কারী ২০টি রোগের একটি। যা চাকরি, পড়ালেখা, সম্পর্ক, পারিবারিক ক্ষেত্র এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের ওপরেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রায় ৫০% রোগীর জীবনে OCD-র লক্ষণ প্রথম প্রকাশ পায় যখন তাদের বয়স ২০ এর কম এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই রোগে আক্রান্তের হার প্রায় সমান।
OCD বা Obsessive Compulsive Disorder কী?
OCD যার পূর্ণরূপ হলো Obsessive Compulsive Disorder, যা মূলত এক ধরনের মানসিক ও স্নায়ুবিক রোগ। OCD শব্দটির মধ্যেই এই রোগটির সম্বন্ধে ধারনা পাওয়া যায়। এর মূল দুটি শব্দ Obsession (অবাঞ্ছিত চিন্তা এবং ভয়) এবং Compulsion (অবাঞ্ছিত চিন্তা এবং ভয় দূর করার জন্য প্রলুব্ধ পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ)। এই Obsessions এবং Compulsions রোগীর স্বাভাবিক জীবনধারাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
আপনি যতই এইসব অবাঞ্ছিত চিন্তা এবং ভয়কে উপেক্ষা করার চেষ্টা করবেন বা দূরে থাকতে চাইবেন, ততই যেন ঐসব চিন্তা এবং ভয়ের অতলসমুদ্রে নিজেকে আবিষ্কার করবেন। যা আপনার অস্বস্তিকে বাড়াবে ছাড়া কমাবে না বরং এর থেকে রেহাই পেতে আপনি কিছু অভ্যাগসগত কর্মের দিকে ধাবিত হবেন। এক পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে নিজের অজান্তেই কাজটি করে ফেলবেন।
OCD এর লক্ষণগুলো কী কী?
বেশিরভাগ OCD আক্রান্ত ব্যক্তিরাই জানেন যে তাদের কাজকর্ম ও আচরণগুলো কিছুটা অস্বাভাবিক। এমন নয় যে তারা এ ধরনের আচরণ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এটা অনেকটা ভাঙা রেকর্ডের মতো মাথার ভেতরে কাজ করতেই থাকে, ফলে একই কাজ বারবার করতে বাধ্য হন তারা। একজন OCD আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে সাধারণত নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো প্রকট আকারে দেখা যায়।
- অপরিষ্কার হওয়া ও জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়।
- যেকোন জিনিস একদম সঠিক স্থানে সঠিকভাবে রাখার প্রবণতা।
- কিছু সময় পরপর বারবার হাত ধোয়া।
- কোন একটি কাজ একইভাবে পরপর কয়েকবার করা বা কোন একটি কাজ করার সময় একই ক্রম অনুসরণের প্রবণতা দেখানো। যেমন: টাকা বা যেকোনো জিনিস গণনার সময় একই ক্রম অনুসরণ করে বেশ কয়েকবার গণনা করা।
- দরজার লক, ফ্যান-লাইটের সুইচ, পানির কল, গ্যাসের লাইন অন-অফ আছে কিনা বারবার চেক করা।
- অন্য বাসার দরজার হাতল ধরা, পাবলিক বাস বা যানবাহন ব্যবহার, পাবলিক টয়লেট ব্যবহারে ভয় কাজ করা।
- একাধিক জিনিসকে একই রকম ভাবে সাজিয়ে রাখা। যেমন: অনেকগুলা সোডা বোতলকে একই ক্রমে সাজিয়ে রাখা।
বাচ্চাদেরও OCD হতে পারে। তবে ২০-৩৫ বছর বয়সী মানুষই এ রোগে অধিক আক্রান্ত হয়। ৩৫ বছর বয়সের পর OCD রোগে আক্রান্তের হার খুবই কম। অটিজম আক্রান্ত শিশুদের অনেকের মাঝে এই রোগটি প্রায়ই দেখা যায়।
OCD এর কারণ সমূহ:
এখনও পর্যন্ত চিকিৎসকেরা নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেনি কেন OCD বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার সমস্যাটি দেখা দেয়। এই সমস্যাটি সাধারণত পুরুষদের চাইতে নারীদের মাঝে বেশি দেখা যায়। তবে সাধারণত তিনটি কারণে কোনো ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে;
বংশগত: সাধারণত বাবা-মায়ের এ রোগটি থাকলে সন্তানেরও এ রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে।
পরিবেশগত: অনেক সময় ব্যক্তি অতিরিক্ত কাজের চাপ, বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হয়। এ ধরনের অভিজ্ঞতা ব্যক্তির মনে অযৌক্তিক চিন্তার সৃষ্টি করে যা থেকে ব্যক্তি সহজে বের হয়ে আসতে পারে না।
মস্তিষ্কের গঠন: Neuro-structural এবং Neurochemical জনিত সমস্যার জন্য OCD হতে পারে।
তাছাড়া OCD অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, যেমন উদ্বেগজনিত ব্যাধি, বিষণ্নতা, টিক ডিসঅর্ডার।
OCD রোগের চিকিৎসা:
OCD আছে এমন অনেকেই এটা নিয়ে লজ্জিত এবং বিব্রত বোধ করেন, কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে OCD রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সঠিক কাউন্সেলিং এবং ওষুধ এর মাধ্যমে রোগীর নানা অযৌক্তিক চিন্তার প্রবণতাকে দূর করার চেষ্টা করা হয়। এখন আমরা OCD নিরাময়ে প্রচলিত কিছু চিকিৎসা প্রদ্ধতি সম্বন্ধে জানবো।
- Cognitive Behavioral Therapy/CBT: OCD এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সব থেকে কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে Cognitive Behavioral Therapy। এ পদ্ধতিটি মূলত একটি কাউন্সেলিং কোর্স।
- Psychological Treatment:
(ক) Exposure and Response Prevention: এক্ষেত্রে রোগীকে তার অযৌক্তিক চিন্তা এবং কাজগুলো থেকে বিরত রাখা হয়।
(খ) Thought Stopping: এক্ষেত্রে যখনই অযৌক্তিক চিন্তা রোগীর মাথায় আসে তখনই তাকে এ থেকে বিরত থাকার পদ্ধতি শিখানো হয়। এতে সে ভাবনা থেকে দূরে সরে আসে।
(গ) Thought Satiation: এক্ষেত্রে রোগীকে অস্বাভাবিক চিন্তাগুলোকে বারবার খাতায় লেখার অভ্যাস করানো হয় এবং দিন শেষে ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট অস্বাভাবিক চিন্তা মোট কতবার করেছে তা দেখানো হয়। এতে রোগী বুঝতে পারে তার চিন্তাটা কতটা অস্বাভাবিক এবং এতে রোগীর সংবেদনশীলতা অনেকাংশে কমে যায়।
(ঘ) Relaxation Training: OCD এর চিকিৎসায় শিথিলায়ন এবং মেডিটেশনও যথেষ্ট কার্যকারী ভূমিকা পালন করে।
একদম সরল বাক্যে বলতে হয় OCD আরোগ্যে কোন চিকিৎসা নেই। কিন্তু সঠিক ওষুধ সেবন, দিকনির্দেশনা পালন ও টক থেরাপিসহ অন্যান্য থেরাপির সাহায্যে এই রোগের প্রবণতাকে অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।
মোঃ গালীব হাসান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: মায়োক্লিনিক