ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন (Female genital mutilation) বা মেয়েদের খতনা; বিষয়টা আসলে কী? বাংলাদেশে মেয়েদের খতনা প্রচলিত না, তাই আমরা এ বিষয়ে তেমন একটা অবগত না। তবে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অনেক দেশে এটি প্রচলিত। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, ২০০ মিলিয়ন নারী পৃথিবীতে জীবিত রয়েছে যাদের genital mutilation করা হয়েছে। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন নারী genital mutilation এর ঝুঁকির মধ্যে থাকে। প্রতি বছর ৬ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মহিলা খতনা বিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়। তাহলে জেনে নেওয়া যাক, ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন (FGM) কী?
Female genital mutilation বা মেয়েদের খতনা হল এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা মেয়েদের প্রতি চরম অন্যায়ের একধরণের রূপ। এটি মূলত মেয়েদের বাহ্যিক যৌনাঙ্গে আংশিকভাবে কাটা বা সম্পূর্ণরূপে অপসারণের অনুশীলন, এবং কোন চিকিৎসার কারণ ছাড়া মেয়েদের যৌনাঙ্গের অন্য কোন ক্ষতি বা আঘাতও এতে অন্তর্ভুক্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মতে, চারটি ভিন্ন ধরণের FGM রয়েছে:
- টাইপ-১ঃ ক্লাইটোরিস (clitoris) এর আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ।
- টাইপ-২ঃ ক্লাইটোরিস এবং ল্যাবিয়া মাইনোরা (labia minora) এর আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ এবং কখনও কখনও ল্যাবিয়া মেজোরা (labia majora) অপসারণ।
- টাইপ-৩ঃ যোনি খোলার পথ সংকীর্ণ বা সেলাই করা, যার সাথে ল্যাবিয়া মাইনোরা এবং মেজোরা এবং কখনও কখনও ক্লাইটোরিস অপসারণ করা হয়।
- টাইপ-৪ঃ এর মধ্যে অন্যান্য সমস্ত ক্ষতিকারক প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমনঃ প্রিকিং, ছিদ্র এবং কৌটারাইজেশন (বার্নিং) অন্তর্ভুক্ত।
FGM এর কোন স্বাস্থ্য উপকারিতা নেই তাও এটা কেন করা হয়?
FGM বা মেয়েদের খতনা প্রথা অনুসরণ করার কারণ এলাকা ভিত্তিতে বিভিন্ন। কিছু কারণের মধ্যে রয়েছে –
১. নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রণঃ মেয়েদের যৌন আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে দেওয়া, যাতে তাদের বিবাহপূর্ব সতীত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে এবং এর ফলে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্কে তারা জড়িয়ে পড়বে না বলে মনে করা হয়।
২. সমাজতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক কারণঃ যেখানে ঐতিহ্য হিসেবে মেয়েদের খতনাকে নারীত্বে প্রবেশ বলে ধরে নেওয়া হয়।
৩. স্বাস্থ্য ও নান্দনিকতার কারণঃ যেখানে মনে করা হয় মহিলাদের যৌনাঙ্গের বহিরাবরণ কুৎসিত।
৪. ধর্মীয় কারণঃ খ্রিষ্ট বা ইসলাম, এমনকি কোনও ধর্মেই এই প্রথার স্বীকৃতি নেই। ধর্মীয় কিছু মতাদর্শের ভুল ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে এই প্রথা চালু রয়েছে।
৫. আর্থ-সামাজিক কারণঃ সেখানে বিয়ের আগে খতনা বাধ্যতামূলক, বিশেষ করে যেখানে মহিলারা স্বামীর উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। এ ছাড়া নারীত্ব ও নম্রতার সঙ্গেও এই প্রথা যুক্ত হয়ে থাকতে পারে।
FGM এর কোন উপকারিতা নেই, রয়েছে শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি!
FGM এর কোনও স্বাস্থ্য সুবিধা নেই বরং এটি মেয়েশিশু ও মহিলাদেরকে বিভিন্নভাবে ক্ষতি করে। এটা মহিলাদের স্বাস্থ্যকর সাধারণ যৌনাঙ্গ টিস্যুর ক্ষতি করে এবং মহিলাদের শরীরের প্রাকৃতিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটায়। সাধারণভাবে বলতে গেলে, সব ধরণের FGM স্বাস্থ্যের ঝুঁকির সাথে যুক্ত। FGM যেসব জটিলতা সৃষ্টি করে তা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
তাৎক্ষণিক জটিলতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
- তীব্র ব্যথা
- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ
- যৌনাঙ্গের টিস্যু ফুলে যাওয়া
- জ্বর
- সংক্রমণ যেমন, টিটেনাস
- মূত্রথলির সমস্যা
- ক্ষত নিরাময়ে সমস্যা
- যৌনাঙ্গের কাছাকাছি টিস্যুর আঘাত
- ঘা
- মৃত্যু
দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
- মূত্রথলির সমস্যা (বেদনাদায়ক প্রস্রাব, মূত্রনালীর সংক্রমণ);
- যোনি সমস্যা (স্রাব, চুলকানি, ব্যাকটেরিয়া ভ্যাজিনোসিস এবং অন্যান্য সংক্রমণ);
- ঋতুস্রাবের সমস্যা (বেদনাদায়ক ঋতুস্রাব, মাসিকের রক্ত প্রবাহে অসুবিধা ইত্যাদি);
- ক্ষতযুক্ত টিস্যু এবং কলোয়েড;
- যৌন সমস্যা (সহবাসের সময় ব্যথা, তৃপ্তি হ্রাস ইত্যাদি);
- প্রসবকালীন জটিলতার ঝুঁকি (কষ্টকর প্রসব, অতিরিক্ত রক্তপাত, সিজারিয়ান) এবং নবজাতকের মৃত্যু;
- পরবর্তীতে আরও চিকিৎসার প্রয়োজন: যেমন, টাইপ-৩ এর FGM করা হলে যৌন মিলন এবং প্রসবের জন্য যৌনিপথ খোলার প্রয়োজন, অনেকসময় যৌনিপথ আবার প্রসবের পরেও বেশ কয়েকবার সেলাই করা হয়, তাই মহিলাদের বারবার খোলা এবং বন্ধ করার পদ্ধতিগুলির মধ্য দিয়ে যায়, এতে তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদী উভয় ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
- মানসিক সমস্যা (হতাশা, উদ্বেগ, ট্রমাজনিত পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, স্ব-সম্মান কম অনুভবের সমস্যা দেখা দেয় ইত্যাদি)
ঝুঁকির মধ্যে কারা?
FGM বেশিরভাগ অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে যেমনঃ নাবালিকা বা কিশোরী এবং কখনও কখনও প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদেরও করা হয়।
FGM অনুশীলনটি মূলত আফ্রিকার পশ্চিমা, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলে, মধ্য প্রাচ্য এবং এশিয়ার পাশাপাশি কিছু দেশে এবং এই অঞ্চলগুলি থেকে আসা অভিবাসীদের মধ্যে দেখা যায়। তাই FGM বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগ।
FGM সংক্রান্ত স্বাস্থ্যগত জটিলতার উপশমের জন্য, WHO এর মতে, ২০১৮ সালে ২৭টি দেশে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছিল। যদি সে পরিস্থিতি চলতে থাকে, তাহলে ২০৪৭ সালে এ খরচ ২.৩ বিলিয়নে পৌঁছাবে।
FGM ৪৪ টি দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে যেসব দেশে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ওখানেও বাস্তবায়ন এখনও পুরোপুরি হয়নি। WHO, UNICEF, UNWomen এর মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এটির বন্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছে। আশা রাখি, ভবিষ্যতে এই জঘন্য অনুশীলন থেকে সারা পৃথিবীর মেয়েরা মুক্তি পাবে।
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ who, givingcompass.org, who.int, ইউনিসেফ, globalcitizen.org