Andean condor (বৈজ্ঞানিক নাম: Vultur gryphus) হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকার একধরনের শকুন জাতীয় পাখি। বাংলায় এদেরকে আন্দিজের কন্ডর বা আন্দিজের শকুন বলা হয়। এরা Cathartidae পরিবারের Vultur গণের একমাত্র সদস্য। এদেরকে সাধারণত আন্দিজ পর্বতমালা, দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিমাংশের প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে পাওয়া যায়। এছাড়াও এদের কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, চিলি, পেরু, বলিভিয়া এবং আর্জেন্টিনার পশ্চিমাংশ থেকে তিয়েরা দেল ফুয়েগো পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। ১৯ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলার পশ্চিমাংশ থেকে তিয়েরা দেল ফুয়েগো পর্যন্ত পুরো আন্দিজ অঞ্চল জুড়ে এই পাখিটির বসবাস ছিলো। তবে বর্তমানে মানুষের কারণে এদের সংখ্যা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে।
সুইডেনের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস ১৭৫৮ সালে তার বিখ্যাত সিস্টেমা ন্যাচার গ্রন্থের দশম সংস্করণে আন্দিজের শকুন বা আন্দিজের কন্ডর সম্পর্কে বর্ণনা দেন এবং এর দ্বিপদ নামকরণ করেন Vultur gryphus। এই পাখিটি প্রতিটি দেশে স্থানীয় নামে পরিচিত। পাখির নামের সাথে এই কন্ডর অংশটি এসেছে কুয়েচুয়া ভাষার কুন্তুর থেকে।
ওজন ও পাখার দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায় এরাই উড়তে সক্ষম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি। ঠোঁট থেকে লেজ পর্যন্ত দেহের দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে এরা ক্যালিফোর্নিয়া কন্ডর থেকে ৭ বা ৮ সে.মি. ছোট কিন্তু ডানার দৈর্ঘ্যে হিসেবে এরা সবচেয়ে বড় পাখি। এদের ডানার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩.৩ মিটার (১০ ফুট ১০ ইঞ্চি)। একটি পুরুষ পাখির ওজন হয় ১১-১৫ কেজি বা ৩৩ পাউন্ড হয় এবং স্ত্রী পাখির ওজন হয় ৮-১১কেজি। পাখিদের মধ্যে শুধুমাত্র গ্রেট আলব্যাট্রস এবং পেলিকানের দুটি প্রজাতির কিছু পাখির মধ্যে আন্দিজের শকুনের মত ডানার দৈর্ঘ্য দেখা যায়।
এই বৃহৎ আকৃতির কালো শকুনটির গলায় কাছে সাদা পালক দিয়ে ঢাকা থাকে, দেখে মনে হয় যেনো মাফলার পরেছে। বিশেষ করে পুরুষ পাখির ডানায় সাদা পালক রয়েছে, এই শকুন একমাত্র প্রজাতি যাদের স্ত্রী পাখি ও পুরুষ পাখির মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। এদের মাথা ও ঘাড়ের রং কিছুটা লাল রঙের এবং এইসব স্থানে কোনো পালক নেই।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে পাখির শরীরের এই লাল রঙের স্থানগুলো এর অনুভূতির সাথে সাথে রঙ পরিবর্তন করে। পুরুষ পাখিদের ঘাড়ে মাংসল চামড়া এবং মাথায় আছে গাঢ় লাল রঙের বড় আকৃতির ঝুটি। পুরুষ পাখিদের চোখের রঙ সাধারণত হলুদ রঙের এবং স্ত্রী পাখিদের চোখের রঙ হয় লাল রঙের। স্ত্রী পাখিরা আকৃতির দিক দিয়ে পুরুষ পাখিদের তুলনায় ছোট এবং তাদের শিকারের ধরণও ভিন্ন।
আন্দিজের শকুন প্রায় ৫৫০০ মিটার উচ্চতায়ও উড়তে পারে। উড়ার সময় এরা ডানার সামনে দিক বাঁকা করে ডানার পালক গুলোকে উপরের দিকে করে বাঁকা হয়ে উড়ে। এরা পাখা না ঝাপটিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। এই শকুনটি উড্ডয়নকালের ১ শতাংশ সময় পাখা ঝাপটাতে ব্যয় করে এবং মাটিতে নামার সময় এরা ৭৫ শতাংশ সময় পাখা ঝাপটায়। পাখির এই ডানা না ঝাপটিয়ে উড়াকে সোরিং বা সেইলিং বলে।
সাধারণত যেসব পাখির ডানা বড় তারা এই প্রক্রিয়ায় উড়ে এবং তাদের শক্তিও কম ব্যয় হয়। তবে এদের দেহের ওজন বেশি হওয়ায় এদের মাঝে মাঝে উড়তে সমস্যা হয় তাই এরা সাধারণত অনেক বাতাস আছে এমন স্থানেই উড়তে পছন্দ করে। মাটি থেকে উড্ডয়নের পর এরা প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা আকাশে থাকে এবং এই সময়ে প্রায় ১০০ মাইল পথ অতিক্রম করে। এরা উড়ার জন্য সাধারণত খোলামেলা পরিবেশ পছন্দ করে।
এই শকুন সাধারণত পাঁচ বা ছয় বছর বয়সে প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে এবং প্রায় ১৬,০০০ ফুট (৫০০০ মিটার) উচ্চতায় বাসা বাঁধে। প্রজনন এর সময় পুরুষ পাখির ঘাড়ের রঙ গাঢ় লাল থেকে হলুদ রঙের হয়ে যায় এবং ঘাড় কিছুটা স্ফীত দেখায়। তারপর পুরুষ পাখিটি তার বুক প্রসারিত করে ঘাড়ের রঙ দেখিয়ে শব্দ করতে করতে স্ত্রী পাখির দিকে অগ্রসর হয়। স্ত্রী পাখির কাছে গিয়ে ডানা প্রসারিত করে, জিহ্বা দিয়ে শব্দ করে তাকে প্রজননে আহবান জানায়।
প্রজননে আহবান করার আরেকটি ধরণ হচ্ছে জিহ্বা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ডানা ছড়িয়ে লাফানো বা নাচা। এই পাখিরা সাধারণত ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ মিটার (৯,৮০০ থেকে ১৬,৪০০ ফুট) উচ্চতায় প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি করতে পছন্দ করে। এরা একবারে একটি ডিম দেয়, ডিমের রঙ হয় নীলাভ সাদা। এদের ডিমের ওজন হয় প্রায় ২৮০ গ্রাম এবং ডিমের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৭৫ থেকে ১০০ মি.মি.।
এরা কোনো সুরক্ষিত স্থানে ডিম পাড়েনা, দেখা যায় এরা কোনো পাহাড়ের চূড়ার কিনারায় ডিম পাড়ে যার জন্য পুরুষ ও স্ত্রী পাখি উভয়েরই ডিমের খেয়াল রাখতে হয়। পাখি ডিম দেওয়ার পর ৫৪ থেকে ৫৮ দিন তাপ দিলে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। বাচ্চা পাখিরা পূর্ণবয়স্ক হতে ৬ থেকে ৮ বছর সময় লাগে। পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তাদের পালক ধূসর রঙের থাকে। তবে পাখিগুলো ছয় মাস বয়স থেকেই উড়তে পারে।
আন্দিজের কন্ডর শকুন প্রজাতির পাখি হওয়ায় এদের খাবারের তালিকায় সাধারণত বড় আকৃতির প্রাণীরাই থাকে। যেমন: এরা সাধারণত হরিণ বা গবাদি পশুর মাংস খেতে বেশি পছন্দ করে। তাছাড়া এরা বুনো শুকর, খরগোশ, লামা, ভেড়া, কুকুর ইত্যাদি খেতে পারে। আবার, এদের বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহ খেতে দেখা যায়। তাই এদেরকে অনেক সময় “ক্লিন আপ ক্রু” বলা হয়। আবার যেসব পাখি উপকূলের কাছাকাছি থাকে তারা সাধারণত সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন: সীল বা অন্যান্য মাছ খায়। এই পাখিদের নখ ধারালো নয়। তবুও তারা অন্যান্য পাখিদের বাসা থেকে ডিম, পাখির বাচ্চা খেয়ে ফেলতে পারে।
অন্যান্য পাখিদের তুলনায় এই পাখিদের জীবনকাল অনেক বেশি, এরা সাধারণত ৫০-৭৫ বছর বাঁচে। “Thaao” নামক একটি পুরুষ পাখির ৭৯ বছর বাঁচার রেকর্ড আছে। পাখিটির জন্ম হয়েছিলো ১৯৩০ সালে এবং এটি মারা যায় ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি। আন্দিয়ান সংস্কৃতিতে আন্দিজের শকুনকে ক্ষমতা ও স্বাস্থ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেকে বিশ্বাস করেন যে আন্দিজের কন্ডর এর হাড় এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গের ঔষধি ক্ষমতা আছে, যার জন্য তাদেরকে হত্যা করা হয়। এদেরকে বর্তমানে চিড়িয়াখানা তে দেখা গেলেও এরা বিলুপ্তির পথে আছে।
নিশাত তাসনিম/ নিজস্ব প্রতিবেদক