পাঁচ বছর গবেষণার পর মালয়েশিয়ায় অনুমোদন পেয়েছে সে দেশের উদ্ভাবিত হেপাটাইটিস সি নিরাময়যোগ্য একটি ঔষধ।
ভাইরাসজনিত রোগসমূহের মধ্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর রোগ হেপাটাইটিস সি। রক্তবাহিত হেপাটাইটিস সি ভাইরাস লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যান্সারেরও কারন হতে পারে। WHO’র দেয়া তথ্যমতে এখন পর্যন্ত এই রোগের কোন ভ্যাক্সিন নেই। এমনকি রোগ হবার পর কার্যকর কোন লক্ষণ ও প্রকাশ পায় না। ফলে রোগ নির্ণয়ের উপায় নেই।
যার কারণে হেপাটাইটিস সি কে বলা হয় ‘নীরব ঘাতক‘। মানবদেহে প্রবেশের পর এ ভাইরাস কোন লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই ধীরে ধীরে ধ্বংস করতে থাকে লিভারকে। লিভারের সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধনের পর যখন রোগ ধরা পড়ে তখন চিকিৎসা হিসেবে বিশেষ কিছুই করার থাকে না। তবে সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার বিশ্বের প্রথম সাশ্রয়ী ও কার্যকর নতুন হেপাটাইটিস সি ঔষধ হিসেবে রেভিডাসভির ও সেফোসবুভির সমন্বিত একটি ড্রাগকে অনুমোদন দিয়েছে। উদ্ভাবকেরা আশাবাদী সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষের সেবায় এটি কার্যকরী হবে।
আবিষ্কার ইতিহাস:
হেপাটাইটিসের ঔষধের মানোন্নয়ন নিয়ে কাজ করে এমন একটি অলাভজনক সহযোগী সংস্থা Drugs for Neglected Diseases Initiative (DNDi)। সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার DNDi এর সাথে পাঁচ বছরের চুক্তিবদ্ধ হবার পর এ বছরের জুনে হেপাটাইটিসের আগের ঔষধ রেভিডাসভির এর সাথে নতুন ঔষধ সেফোসবুভির যুক্ত করে ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
DNDi এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিচালক জিন মিশেল পিডাগনেল বলেন, “আমরা একটি কার্যকর চিকিৎসা ফল পাবার জন্য মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সাথে কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইতোমধ্যে আমরা মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছি। আমরা একটি সাশ্রয়ী মূল্যের চিকিৎসা দিতে আগ্রহী।”
নতুন ঔষধ:
নতুন এই ঔষধটি তৈরিতে মিশরের জেনেরিক ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফারকো এর সাথে কাজ করবে DNDi। এটি একটি Direct Acting Antiviral (DAA) বা সরাসরি কার্যকরী ভাইরাসরোধক। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম DAA হিসেবে সুরক্ষা অনুমোদন পায় সেফোসবুভির।
এতদিন এই রোগটি নির্মূলে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ দিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই ঐ ঔষধগুলো ক্ষতিকর প্বার্শ প্রতিক্রিয়া বহন করে যা রোগীর অবস্থা আরও খারাপ করে তুলতে পারে। পিডাগনেল বলেন, “DAA একটি বিপ্লব ছিল। এটি প্রথমবারের মতো কম প্বার্শ প্রতিক্রিয়ায় রোগীদের একটি কার্যকর প্রতিকার দিচ্ছিল।” কিন্তু মার্কিন ঔষধ প্রস্তুতকারক ‘গিলিয়েডের’ আওতাধীন সে ঔষধ অনেক ব্যয় বহুল এবং অনেক উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশের নাগালের বাইরে ছিল।
২০১৪ সালে মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ধারণা করা হয় মালয়েশিয়াতে কমপক্ষে ৪ লক্ষ মানুষ হেপাটাইটিস সি নিয়ে বসবাস করছে৷ এরপর ২০১৬ সালে রেভিডাসভির ও সেফোসবুভির সমন্বিত ঔষধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়। মোট ৩০৯ জন রোগীকে নিয়ে এই ট্রায়াল দেয়া হয়। সেখানকার এক ব্যক্তি ছিলেন এনজি সং পিং। চিকিৎসা শুরুর তিনমাস পর টেস্টে তার শরীরে আর কোন ভাইরাস ধরা পড়ে নি। আল-জাজিরাকে দেয়া এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি জানান এখন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ।
ট্রায়ালের ফলাফল:
এপ্রিল মাসে The Lancet এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে সমন্বিত ঔষধের ট্রায়ালকে অত্যন্ত কার্যকর ও সংবেদনশীল বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এটি ৯৭% ক্ষেত্রে নিরাময়যোগ্য। আরও একটি সুখবর লিভার ক্যান্সার, সিরোসিস বা লিভার ফেইলিউরের মতো জটিল রোগ প্রতিরোধ করা এখন সহজলভ্য হবে এই ঔষধের সুবাদে। ট্রায়ালের সাফল্যের অংশ হিসেবে মালয়েশিয়া সরকার স্থানীয় সরকারি ক্লিনিকগুলোকে টার্গেট করে হেপাটাইটিস সি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য একটি সম্পূর্ণ এক্সেস তৈরি করেছে।
আশার আলো:
DAA চিকিৎসা সচরাচর হবার পর ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নেয়া লোকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১০ হাজারের অধিক রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। গত বছর কোভিড-১৯ মহামারী সত্ত্বেও প্রায় ৪,০০০ রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা হয়। WHO ২০৩০ সালের মধ্যে সংক্রমণ ৯০ শতাংশ ও মৃত্যু ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে চায়।
এ মাসে হেপাটাইটিস সি এর অন্যতম বড় সংক্রমণ অঞ্চল মিশর নতুন এ ঔষধের জন্য নিবন্ধন করেছে। প্রত্যাশা রয়েছে রেভিডাসভির প্লাস সেফোসবুভির সমন্বিত থেরাপি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশেও অনুমোদন পাবে।
মো. মাসরুল আহসান/ নিজস্ব প্রতিবেদক
+1
+1
+1
1
+1
+1
1
+1
+1