“সবার ৮ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন। রাতে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমানো সবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর শান্তিপূর্ণ ঘুম আমাদের দেহকে নতুন দিনের কাজকর্মের জন্য পুনরায় সতেজ করে তোলে”, ছোটবেলা থেকে আমরা বড়দের কাছ থেকে এমন উপদেশ সবাই পেয়ে থাকি। কিন্তু ৮ ঘন্টা ঘুমের ব্যাপারটি কি আসলেই সত্য নাকি এটি শুধুমাত্র মিথ?
এসব ধারণার কারণেই বেশিরভাগ সময় যখন রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হয়, তখন আমরা চিন্তায় পরে যাই, পরের দিন কীভাবে এই অল্প কয়েক ঘন্টা ঘুম দিয়ে সুস্থ থাকব? তবে সত্য হলো ঘুমের কোন আর্দশ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই। কিছু মানুষের জন্য আট ঘন্টার বেশি ঘুমের প্রয়োজন হতে পারে, আবার কেউ ছয় ঘন্টা ঘুম দিয়েই সুস্থভাবে দিন পার করতে পারে!
এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে একজন মানুষের কত ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন?
এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোন উত্তর নেই! প্রতিদিন কত ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন, তা আপনার পানির প্রয়োজনীয়তার মতোই অনির্দিষ্ট। কেউ জানে না আপনার ঠিক কি পরিমাণ পানির প্রয়োজন, ঘুমের ক্ষেত্রেও একই বিষয়টি প্রযোজ্য। এটি পৃথক পৃথক মানুষের ভিন্ন হতে পারে। আপনার শরীরের অবস্থার উপর নির্ভর করেও ঘুমের পরিমাণ পরিবর্তিত হয়। গবেষণা বলে, ঘুমের ধরণ এবং ঘুমের সমস্যাগুলো বংশগত। সুতরাং, ঘুম সম্পর্কিত সমস্যাগুলো আপনার ডিএনএ এর কারণেও হতে পারে।
অনেকে ৪-৬ ঘন্টা ঘুমিয়েও পুরোপুরি সতেজতা অনুভব করে। সফল হওয়া ব্যাক্তিদের মাঝে কম ঘুমানোর অভ্যাসটি দেখা যায়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH) এর রিপোর্ট মতে, বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালে “short-sleep gene” নামে একটি জিন আবিষ্কার করেন। এই জিনবিশিষ্ট মানুষ কোন অসুস্থতা ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে ৬.৫ ঘন্টার কম ঘুমায়। এই আবিষ্কারটি অবশ্যই ঘুমের মতো বড় ধাঁধার একটি ছোট্ট মাত্র অংশ। তবে এতে প্রমাণিত হয় যে, ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত স্বতন্ত্র এবং জেনেটিক্স দ্বারা প্রভাবিত।
আপনি ছয় ঘন্টা ঘুমের পরেও ঘুমের অভাব অনুভব করতে পারেন, সম্পূর্ণ সতেজতা পেতে আপনার নয় ঘন্টা বিশ্রামেরও প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও, কিছু বাহ্যিক কারণও আপনার ঘুমের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাহলে এখন এমন কিছু বাহ্যিক কারণ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
মাসিক চক্রঃ
পিরিয়ডের আগে এবং পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে কোন মেয়ের শরীর অনেক অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ব্যথা, মুড সুয়িং এবং ক্লান্তির কারণে প্রায়ই ঘুমানো বা ঘুমিয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠে। এই সময়ে মহিলাদের সুস্থ হওয়ার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুমের প্রয়োজন হতে পারে। আর এতে বুঝা যায় যে, পিরিয়ডের পরবর্তী সময়ে ঘুমের পরিমাণও হ্রাস পায়।
ঋতু পরিবর্তনঃ
বাহ্যিক পরিবেশ এবং তাপমাত্রা আপনার ঘুমের চাহিদারও পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের সময় পরিবর্তন মেলাটোনিনের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। পাশাপাশি আপনার যে সময়ে ঘুম পাওয়া শুরু হয়, সেই অনুভবের সময়টিকে প্রভাবিত করে। আপনার বসবাসের অঞ্চলে যদি সূর্য স্বাভাবিকের চেয়ে পরে ডুবে, তবে আপনার গভীর রাত অবধি ঘুম আসবে না। যেমন শীতকালে, তখন রাতগুলো দীর্ঘ হয় এবং আমরা সারা দিন কম রোদ পাই, যা আমাদের আরও ক্লান্ত অনুভব করায়। তাই, আমরা শীতকালে দীর্ঘ সময় ঘুমাই।
স্বাস্থ্য সমস্যাঃ
আমরা যখন সুস্থ থাকি তখন আমাদের কম বিশ্রাম দরকার। ঘুম আমাদের শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করে। তাই যখন অসুস্থ থাকি, তখন সংক্রমণের সাথে লড়াই করার জন্য আমাদের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুম প্রয়োজন। আসলে, অতিরিক্ত ঘুমানো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যের লক্ষণও হতে পারে।
এখন আপনার মনে একটা প্রশ্ন থেকেই যাবে, স্বাভাবিক অবস্থায় তাহলে ঘুমের আদর্শ সময়টি কীভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব?
উত্তর হলো, আমাদের সবার জীবনযাত্রার ধরণ একে অপরের থেকে আলাদা। আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস, ওয়ার্কআউট, স্বাস্থ্য অবস্থা এবং কাজের সময়সূচী ভিন্ন। তাই, আপনার কতটা ঘুম দরকার তা নির্ধারণ করার কোনো আদর্শ উপায় নেই। ঘুম থেকে উঠার পর আপনি কেমন অনুভব করেন তার উপরই নির্ভর করে আপনার কত ঘন্টা ঘুম দরকার। এটিই হচ্ছে সেরা পদ্ধতি।
ছয় ঘন্টা ঘুমানোর পর যদি আপনি পুরোপুরি সতেজ এবং সক্রিয় অনুভব করেন, তবে এটি অবশ্যই একটি ভাল লক্ষণ। উল্টোটি যদি ঘটে, আপনার ঘুমের সময় বাড়ানো দরকার। তবে অতিরিক্ত ঘুম অবশ্যই এড়িয়ে চলা প্রয়োজন, কারণ এটি আরো নতুন নানা সমস্যার সৃষ্টি করবে।
অতএব, রাতে সবাইকে ৮ ঘন্টা পুরোপুরি ঘুমাতে হবে এমন কোন কথা নেই। এর কম ঘুম হলেও চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনি আপনার ঘুমের পরিমাণ নিজেই নির্ধারণ করুন, ঠিক যত ঘন্টা ঘুম হলে আপনি সতেজতা অনুভব করেন, তত ঘন্টা ঘুমই আপনার প্রয়োজন। সেই পরিমাণটা ৬ ঘন্টা হোক বা ৮ ঘন্টা বা এর চেয়েও বেশি!
তানজিনা সুলতানা শাহীন/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসুত্র : Times Of India, CNET