গ্লোবাল ওয়ার্মিং তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বর্তমান বিশ্বে একটি উদ্বেগজনক সমস্যা। এই উষ্ণায়নের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং এর ফলশ্রুতিতে হিমবাহ পর্বতসমূহের বরফ গলন এর ফলে দিন দিন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্প্রতি Nature Journal এ প্রকাশিত একটি সদ্য গবেষণায় দেখা গেছে ২০১৫ সালের পর থেকে প্রতি বছর প্রায় ২২০,০০০ হিমবাহ পর্বত থেকে প্রায় ৩২৮ বিলিয়ন টন (২৯৮ বিলিয়ন মেট্রিক টন) বরফ ও তুষার গলে সমুদ্রে মিশছে। Nature Journal এর এই তথ্যমতে বরফ গলনের এই পরিমাণ সুইজারল্যান্ড এর ভূ-পৃষ্ঠ প্রতি বছরে প্রায় ২৪ ফুট তলিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
নতুন এই সমীক্ষা বলছে হিমবাহ পর্বতসমূহ হতে এই বরফ গলনের হার প্রায় অর্ধেক অংশই পরিলক্ষিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা তে। এছাড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য বিশ্বের সবচাইতে বেশি বরফ গলন-এর হার পরিলক্ষিত হয় আলাস্কা তে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়াতে হিমবাহ পর্বতসমূহের বরফ এক বছরে প্রায় ১১৫ ফুট পর্যন্ত গলে গিয়েছে। স্যাটেলাইটের ত্রিমাত্রিক চিত্রভিত্তিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ১৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে প্রায় ৩১ শতাংশ দ্রুত এই তুষারপাত ও বরফ গলন।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ হতে ২০১৯ সাল অব্দি বরফ গলনের হার প্রায় ৭৮ বিলিয়ন টন বেশি পূর্ববর্তী ২০০০ হতে ২০০৪ সাল অব্দি বরফ গলনের হারের তুলনায়।
ফ্রান্সের ETH Zurich এবং University of Toulouse এর একজন Glaciologist Romain Hugonnet বলেন, “গত ২০ বছরে বরফ গলনের এই হার বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন যা সত্যিই বিস্ময়কর।” সমীক্ষা বলছে বিশ্বের প্রায় সমস্ত হিমবাহ পর্বতসমূহের বরফ-ই গলছে। তিব্বত এ এই গলনের হার স্থিতিশীল থাকলেও আইসল্যান্ড এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এ তুষারপাতের পরিমাণ বাড়ছে এবং পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে গলনের হার ত্বরান্বিত হচ্ছে।
Hugonnet আরও যুক্ত করেন, “তেল, কয়লা ও গ্যাস পোড়ানো সহ বিভিন্ন গ্রীনহাউজ গ্যাস প্রতিক্রিয়া দায়ী এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য যা আমাদের জন্য হুমকীস্বরুপ।” এছাড়াও বিশ্বের কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিমবাহ খন্ডগুলিও নাকি বিলুপ্ত হচ্ছে দিন দিন। দু বছর পূর্বে এই খন্ডসমূহ বিলুপ্তি রহস্য সমাধানে আইসল্যান্ড এর একদল গবেষক একটি গবেষণা ও চালিয়েছিলো।
World Glacier Monitoring Service এর পরিচালক Michael Zemp বলেন, “১০ বছর পূর্বে আমাদের ধারণা ছিলো হিমবাহগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের সূচক তবে অদ্ভুত হলেও সত্যি বর্তমানে এই হিমবাহগুলি জলবায়ু সংকটের অন্যতম স্মরণিকায় পরিণত হচ্ছে।”
সমীক্ষা অনুযায়ী এটিই সর্বপ্রথম স্যাটেলাইট ভিত্তিক ত্রিমাত্রিক চিত্রায়ণ পর্যবেক্ষিত হিমবাহগুলির এবং এদের সাথে গ্রীনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকার বরফ শীটগুলোর কোনওপ্রকার যোগসূত্র নেই।
Michael Zemp আরও যুক্ত করেন, “অতীত সমীক্ষাগুলি কেবলমাত্র হিমবাহগুলির একটা ভগ্নাংশ হিসেব করেছে অথবা কক্ষপথের সাপেক্ষে মহাকর্ষ পরিমাপ ব্যবহার করে ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক ধারণা প্রদান করেছে। তবে এই মাধ্যাকর্ষণ পরিমাপ ও এই পরীক্ষণ হতে প্রাপ্ত পাঠ ত্রুটিযুক্ত এবং এটি তেমন কার্যকর ও নয়।
Ohio State University-র অধ্যাপক Lonnie Thompson নতুন এই সমীক্ষাটিতে সম্মতির প্রেক্ষিতে বলেছেন, “সম্প্রতি নতুন এই সমীক্ষাটি একটি উদ্বেগজনক চিত্র প্রকাশ করছে৷”
Romain Hugonnet আরও যুক্ত করেন, “হিমবাহ পর্বতগুলির বরফ ডুবে যাওয়া ও গলন লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য হুমকীস্বরুপ। বিশেষ করে যারা মৌসুমী হিমবাহ গলনের উপর নির্ভরশীল তাদের জন্য এই হুমকির মাত্রা আরও বেশি। এই হিমবাহ হ্রদগুলির দ্রুত গলন ভারত এর মত দেশগুলোর জন্য মারাত্মক বিপদের কারণ হতে পারে কেননা তা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে তুলছে।”
সমীক্ষা হতে আরও লক্ষ্য করা যায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্যে আইস শীটসমূহের তুলনায় হিমবাহ পর্বতসমূহের বরফ গলন প্রায় ২১ শতাংশ বেশি দায়ী। এছাড়া এই বরফ গলন সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির জন্য এক দীর্ঘমেয়াদী হুমকি স্বরুপ বিবেচিত।
National Snow & Ice Data Center এর পরিচালক Mark Serreze বলেছেন, “এটি সুস্পষ্ট যে, আমরা একবিংশ শতাব্দীর মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান আরও বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এটি ভবিষ্যতের জন্য আরও হুমকীস্বরুপ।
বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট বরফ গলনের ফলে দিন দিন যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বেড়ে চলেছে তা ভবিষ্যতের জন্য আরও বেশি উদ্বেগজনক। পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমিয়ে ও বিভিন্ন গ্রীনহাউজ গ্যাসসহ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী ব্যাপারসমূহকে শীঘ্রই কঠোর ও সচেষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে কার্যকরের ভিত্তিতে এই সমস্যা হতে উত্তরণের পথ সুগম করা এখন অতীব আবশ্যক।
তন্ময় ইসলাম তানভীর/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ nbcnews.com, usatoday.com