নিউট্রন স্টার (Neutron star) কি?
মহাকাশে সব সময় ভাঙাগড়া চলছে। এই ধ্বংস ও সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিউট্রন তারকার উদ্ভব ঘটে। নিউট্রন স্টার হলো একটি দৈত্যাকার নক্ষত্রের অবশিষ্টাংশ যা সুপারনোভার মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়ে তুলনামূলক ছোট আকারের তারকায় পরিনত হয়, যার কেন্দ্রে অল্প জায়গায় অধিক ঘনত্বে অনেক বেশি ভর কেন্দ্রীভূত থাকে। মহাবিশ্বের কোথাও বিশাল আকারের তারার প্রচন্ড বিস্ফোরণকে সুপারনোভা বলে।
যেভাবে নিউট্রন স্টার গঠিত হয়ঃ
বড় বড় তারকাগুলো তাদের গোলাকৃতির আকার বজায় রাখতে চায়। কারণ তাদের বিশালাকার ভর ভারী মহাকর্ষ বলের দরুন তাদের গ্যাসকে কেন্দ্রবিন্দুর দিকে টানতে চেষ্টা করে। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA) জানিয়েছে, তারাগুলো তাদের কেন্দ্রে পারমাণবিক সংশ্লেষণের শক্তির কারণে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে ও জীবনের শেষদিকে তাদের জ্বালানী এবং অভ্যন্তরীণ ফিউশন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে সূর্যের ভরের চার থেকে আটগুণ ভর লাভ করে।
তারপরে বিপুল আকারে সুপারনোভা হিসাবে বিস্ফোরিত হয়। তখন তারার কেন্দ্রীয় অংশ দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে পড়ে, পরে বস্তুকণার ইলেকট্রন-প্রোটন প্রবল চাপে পিষ্ট হয়ে নিউট্রনে মিশে যায়। এর ফলে নিউট্রিনো নামক একপ্রকার আলোক কণার সৃষ্টি হয়। এই লাইটওয়েট কণা সেই সময় দূর মহাবিশ্বে ছড়িয়ে যায়।
বিস্ফোরিত তারার শেষ পরিণতি হলো একটি অধিক চাপে ঘনীভূত তারা, যার ভর অন্য 4/5 টা তারার 90%। মাত্র 10 থেকে 12 মাইল ব্যাসের একটি নিউট্রন তারার ওজন অনেক বড় বড় তারার চেয়েও বেশি। এভাবেই নিউট্রন স্টার গঠিত হয়। সৃষ্ট নিউট্রন স্টার এর কণাগুলো এত কাছে আসে, যার কারণে তারা একে অপরকে ছেড়ে যাওয়ার শক্তি পায় না। তাই নিউট্রন স্টারের কেন্দ্রে ধ্বংসের সৃষ্টি হয় না। ফলে নিউট্রন স্টারটি আর ভেঙে যেতে পারে না, সুপারনোভার মতো বিস্ফোরিত হতে পারে না।
নিউট্রন তারার বৈশিষ্ট্যঃ
নিউট্রন স্টার আবিষ্কার হওয়ার পরপরই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা 1930-এর দশকে এই উদ্ভট মহাকাশীয় বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে তাত্ত্বিক ধারণা করেছিলেন। তবে 1967 সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের কাছে নিউট্রন স্টারের অস্তিত্বের জোরালো কোনো প্রমাণ ছিল না। আমেরিকান ফিজিকাল সোসাইটির মতে, ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জোসলিন বেল (Jocelyn Bell) নামে একজন স্নাতক শিক্ষার্থী তার রেডিও টেলিস্কোপে তারার কিছু অদ্ভুত শাখাপ্রশাখা লক্ষ্য করেছিলেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন যে, এই তারা সম্ভবত আগের কোনো যুগ বা সভ্যতার সংকেত হতে পারে। আমেরিকান ফিজিকাল সোসাইটি জানিয়েছে, এটি মূলত দ্রুত ঘূর্ণায়মান নিউট্রন স্টার দ্বারা নির্গত বিকিরণ।
বড় তারার পতনের পর নিউট্রন তারকা গঠিত হওয়ার জন্য এমন একটি সুপারনোভা কমপ্যাক্ট অবজেক্টকে প্রচুর পরিমাণে শক্তি সরবরাহ করতে হয়। নিউট্রন স্টার জন্মের সময় থেকে মহাকাশে প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকে। ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের কৌণিক গতি বাড়তে থাকে। যার ফলে এটি তার অক্ষের উপর প্রতি সেকেন্ডে 0.1 থেকে 60 গুণ গতিতে এবং প্রতি সেকেন্ডে 700 বার পর্যন্ত ঘুরতে থাকে।
এই নতুন নক্ষত্র মজবুত চৌম্বকীয় ক্ষেত্রগুলি বিকিরণের জন্য উচ্চ-শক্তিযুক্ত কলাম তৈরি করে, যা লাইটহাউস বিমের মতো পৃথিবী পেরিয়ে যেতে থাকে। শত শত কোটি বছর পর এদের গতি কমে আসতে থাকে। কিন্তু যেসব নিউট্রন তারা তখনাে ঘুরতে থাকে তখন ওদের আকাশে মিটমিট করে জ্বলতে দেখা যায়। এদের বলা হয় পালসার (pulsar)। মহাকাশে তখন এই পালসার টিপটিপ করে জ্বলে- নেভে। একসময় এদের ভেতরের শক্তি বিকিরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে সাধারণ নিউট্রন তারায় পরিণত হয়।
নিউট্রন নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি এই পৃথিবীর সকল পদার্থের বৈশিষ্ট্য থেকে পুরোপুরি ভিন্ন ধরণের। নিউট্রন তারার কেন্দ্রে যে প্রচণ্ড চাপ থাকে, তাকে বিগ ব্যাংয়ের সময় বিরাজমান চাপের সঙ্গে তুলনা করা চলে। অবশ্য পৃথিবীতে এর তুলনীয় রূপায়ণ বা সিমুলেশন সম্ভব নয়। নিউট্রন স্টার মহাজাগতিক পদার্থের মধ্যে সবচেয়ে ঘনীভূত বস্তু এবং পদার্থের সমষ্টি।
নিউট্রন স্টারের দুইটি কণার মধ্যকার আকর্ষণ শক্তি এত্ত বেশি যে, একটি কণা থেকে অন্য কণার দূরত্ব এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত দুইটি পদার্থের কণার সবচেয়ে কম দূরত্ব। তাই নিউট্রন স্টারের এক চা চামচ পদার্থের ওজন এক বিলিয়ন টন। আরো সহজ ভাষায় বললে, নিউট্রন স্টারের একটি মার্বেল সমপরিমাণ পদার্থের ওজন 1 বিলিয়ন টন।
আপনি যদি কোনোভাবে মারা না গিয়ে নিউট্রন স্টারের পৃষ্ঠের উপরে দাঁড়াতে পারেন, তবে আপনি পৃথিবীতে যে পরিমাণ মহাকর্ষ অনুভব করছেন তার চেয়ে 2 বিলিয়ন গুণ বেশি শক্তিশালী মহাকর্ষের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। এরকম আরো অনেক তাক লাগানো বিষয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মহাবিশ্বে, আসলেই আমরা তার কতটুকু জানি? অনেক কিছুই আমাদের অধরা- অজানা রয়ে গেছে।
একটি সাধারণ নিউট্রন তারার চৌম্বকীয় ক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী হতে পারে। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা(NASA) জানিয়েছে, পৃথিবীতে একটি চৌম্বকের পৃষ্ঠ ক্রাস্টাল মুভমেন্টের সমতুল্য ভূমিকম্প উৎপন্ন করে প্রচুর পরিমাণে শক্তি মুক্তি করতে পারে। পৃথিবীতে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র গত 100,000 বছরে যে পরিমাণ শক্তি নির্গমন করেছে, নিউট্রন স্টারের চৌম্বক ক্ষেত্র তার চেয়ে বেশি শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম।
নিউট্রন তারা নিয়ে গবেষণাঃ
গবেষকরা মহাকাশযান চলাচলে সহায়তা করতে এবং নিউট্রন তারার স্থিতিশীল অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার জন্য ঘড়ির মতো কাটা ব্যবহার করার একটি চিন্তাভাবনা করেছেন। যা জিপিএস(GPS) বিমের মতোই পৃথিবীর মানুষকে গাইড করতে সহায়তা করবে। এই সিস্টেমটিকে বলা হয় ‘এক্স-রে টাইমিং অ্যান্ড নেভিগেশন টেকনোলজি (Station X-ray Timing and Navigation technology)। SEXTANT-এর জন্য স্টেশন এক্সপ্লোরার নামক আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন (ISS) থেকে তারা একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। গবেষকরা আইএসএসের অবস্থানটি 10 মাইল (16 কিমি) এর মধ্যে গণনা করতে পালসার থেকে একটি সিগন্যাল ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সর্বকালের সবচেয়ে বড় নিউট্রন নক্ষত্রের সন্ধান পেয়েছিলেন। এই নিউট্রন স্টার আমাদের সূর্যের প্রায় ২.১৪ গুণ ভর এবং প্রায় ১২.৪ মাইল (২০ কিলোমিটার) জুড়ে একটি গোলকের মধ্যে পাক খাচ্ছিলো। নিউট্রন তারকাটি এমন একটি সীমাতে রয়েছিলো যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী এটি একটি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।অবজেক্টটি কেন কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হলো না এবং পদার্থবিজ্ঞানের এই অজানা বিষয় নিয়ে গবেষকরা অনেক গবেষণা চালিয়েছেন।
নিউট্রন-স্টার ডায়নামিক্সকে আরও ভালভাবে অধ্যয়নের জন্য গবেষকরা নতুন সরঞ্জামের ব্যবস্থা করছেন।পদার্থবিজ্ঞানীরা লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি (Laser Interferometer Gravitational-Wave Observatory (LIGO)) ব্যবহার করে দুটি নিউট্রন নক্ষত্র একে অপরকে বৃত্তাকার এবং তারপরে সংঘর্ষে নির্গত মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই শক্তিশালী তরঙ্গ এবং সংযোজনগুলি প্ল্যাটিনাম, স্বর্ণ এবং ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় উপাদান সহ পৃথিবীতে অনেক মূল্যবান ধাতু তৈরির জন্য দায়ী হতে পারে।
মাহফুজ আহমেদ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ লাইভ সাইন্স, নাসা, স্পেস ডট কম