বর্তমান সময়ে পরিবেশবাদীরা বারবার বলে আসছে, মানুষের তার দখলদারি মনোভাবকে লাগাম দেওয়া দরকার। একটি নতুন সমীক্ষা প্রমাণ করেছে যে, তাদের দাবি আক্ষরিক অর্থে কতটা যৌক্তিক। গবেষকরা গ্রহের উপরে আমাদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের প্রতীক হিসাবে ইতিহাসের এই হতাশাজনক মুহুর্তটির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
যদিও পৃথিবীর জীবকুলের ভর প্রায় ১.১ ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন এ দাঁড়িয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি, তবে কৃত্রিম পদার্থের বা মানবসৃষ্ট পদার্থের তথাকথিত “anthropogenic mass” ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কংক্রিটের ফুটপাথ, আকাশচুম্বী দালানকোঠা থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের বোতল, কাপড় এবং কম্পিউটার পর্যন্ত সমস্ত যা কিছুই মানুষেরা তৈরি করেছে, তা এখন পৃথিবীর প্রায় সকল জীবন্ত জিনিসের ভরের সমান এবং এই বছর তা ছাড়িয়েও যেতে পারে বলে জানিয়েছে Nature এ প্রকাশিত একটি গবেষণা। ইসরাইলের ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা গবেষণাটি পরিচালনা করেছে।
অনুসন্ধানটি এই যুক্তিটিকে আরও জোরদার করতে পারে যে পৃথিবী অ্যানথ্রোপসিন এপোক-এ (Anthropocene) প্রবেশ করেছে। অ্যানথ্রোপসিন এপোক (Anthropocene Epoch) হলো ভূতাত্ত্বিক সময়ের একটি একক, যা পৃথিবীর ইতিহাসের সাম্প্রতিক সময় সম্পর্কে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়, যখন মানুষের ক্রিয়াকলাপ গ্রহের জলবায়ু এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মানব কার্যকলাপ পৃথিবীকে অ্যানথ্রোপসিনে ঠেলে দিয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কারণ হতে পারে উক্ত অনুসন্ধান।
এটি পাশাপাশি ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে যে আমরা কীভাবে বৈশ্বিক বাস্তুতন্ত্রকে রূপান্তর করতে, জলবায়ুকে পরিবর্তন করতে এবং অগণিত প্রজাতিকে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চালিত করতে মূল ভুমিকা পালন করছি।
গবেষণাটি এই গ্রহের উপর মানুষের প্রভাবকে বোঝার প্রথম প্রচেষ্টা নয়। ২০১৬ সালে, বিজ্ঞানীদের একটি দল “টেকনোস্ফিয়ার” (technosphere)– পরিবেশের এমন একটি অংশ যা মানবসৃষ্ট বা পরিবর্তিত হয়) এর ওজন অনুমান করেছে। এটি কেবলমাত্র ভবন এবং পণ্যের ওজন নয়, এটি জমি এবং সমুদ্রক্ষেত্রের আনুমানিক ওজন যা আমরা খনন, পরিমার্জন করে শহর তৈরি করতে ব্যবহার করেছি।
তারা ৩০ ট্রিলিয়ন টন ভরের একটি হিসেব দিয়েছিল। অন্যান্য সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে কেবল জৈব বিশ্বের (Biological World) পরিবর্তনগুলো সনাক্ত করা হয়েছে, যেমন উদ্ভিদ কতটুকু কার্বনের পরিমাণ সংরক্ষণ করে বা গ্রহে প্রাণীকূলের সংখ্যা কত। কৃত্রিম এবং জৈবিক বিশ্বের ভরের পরিবর্তনগুলো পৃথকভাবে দেখার জন্য কোনো বিস্তৃত বিশ্লেষণ এতদিন পর্যন্ত হয়নি।
এই জ্ঞানের ফাঁক পূরণ করতে, মিলো এবং তার সহকর্মীরা কৃত্রিমভাবে তৈরি পদার্থ এবং প্রাণীকুলের ভর সম্পর্কিত পূর্বে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি ডেটাসেট একসাথে করেন এবং কীভাবে ১৯০০ সাল থেকে বর্তমান সময়ে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে তার একটি টাইমলাইন তৈরি করেন। মানবসৃষ্ট পদার্থের ওজন অনুমান করার জন্য, তারা মূলত ভিয়েনার ইনস্টিটিউট অফ সোস্যাল ইকোলজি এবং ইউনিভার্সিটি অফ ন্যাচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেসের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, যারা বছরের পর বছর ধরে জাতীয় পরিসংখ্যান, শিল্প গ্রুপ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করে আসছিল।
দলটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোলজির উপর চালিত বিভিন্ন গবেষণা থেকে গত ১২০ বছর ধরে অ্যানথ্রোপোজেনিক ভর অনুমান করেছে; এবং স্যাটেলাইট ডেটা এবং গ্লোবাল উদ্ভিদ মডেলগুলির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বায়োমাসের তথ্য সরবরাহ করেছিল।
বিশ শতকের শুরুতে, মানুষ নির্মিত কৃত্রিম সামগ্রীর ভর ছিল ৩৫ বিলিয়ন টন, যা বিশ্বব্যাপী বায়োমাসের প্রায় ৩ শতাংশ। তখন থেকে শুরু করে এই ভর আজ প্রায় ১.১ ট্রিলিয়ন টনে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি এখন বছরে ৩০ বিলিয়ন টন হারে আরোও জমা হচ্ছে, যা অনুযায়ী পৃথিবীর প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতি সপ্তাহে তার নিজের ওজনের চেয়ে বেশি কৃত্রিমভাবে নির্মিত পণ্য তৈরি করে।
এই জিনিসগুলির বেশিরভাগই হলো কংক্রিট- মানুষের প্রিয় বিল্ডিং তৈরির উপাদান- এর পরে রয়েছে নুড়ি, ইট, ধাতু। সমীক্ষা অনুসারে, যদি চলমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে তবে মানব-উৎপাদিত পদার্থগুলো ২০৪০ সালের মধ্যে মোট জীবিত জৈববস্তুর পরিমাণের তিন গুণের সমান হবে।
জীবিত বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ, গাছ এবং গুল্ম দ্বারা গঠিত। এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, মানুষেরা নিজেরাই বিশ্বের জীবিত বায়োমাসের ০.০১%।
ইতিমধ্যে, হাজার হাজার বছর মানুষ জমিতে ফসল ফলাতে এবং পশুপালন বৃদ্ধির জন্য পৃথিবীতে গাছের পরিমাণ হ্রাস করে আসছে। সমীক্ষা অনুসারে, পৃথিবীতে সমস্ত জীবিত উদ্ভিদের ওজন বর্তমানে প্রায় ১ Teratonne ,যা ১২০০০ বছর পূর্বের তুলনায় অর্ধেক।
এমন নয় যে আমাদের জিনিসগুলি তৈরি করা বন্ধ করা উচিত, তবে আমরা পরিবেশে কী প্রভাব ফেলছি সে সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত এবং আমরা কীভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করব সে সম্পর্কে আমাদেরকে চিন্তা করা দরকার। আমাদের সিদ্ধান্ত, আমাদের সৃষ্ট কৃত্রিম পদার্থ জীবকূলের ভরের দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে যাওয়া কোনো ভাল কিছু না এবং তা কোনো ভাল লক্ষণও না। তাই আমাদের উচিত নিজেদের ভালোর জন্যই পরিবেশের ভালোর কথা চিন্তা করা। মানবসৃষ্ট দূর্যোগেই যেন মানবজাতি ধ্বংস না হয়ে যায়!
কায়েস মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: ন্যাচার, ন্যাশনাল জীওগ্রাফিক, সিএনএন, সাইন্স এলার্ট
+1
3
+1
1
+1
+1
+1
+1
2
+1
2