ভারত মহাসাগরের নিচে থাকা বিশালাকার টেকটোনিক প্লেটটি নিজেই পাথুরে ভাঙনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ভূতাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এই ফলক বা প্লেটটি অল্প সময়ের মধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে।
মানুষের কাছে এই ভাঙনটি বলা যায় অনন্তকাল সময় নিবে। শামুকের গতিতে ভারত-অস্ট্রেলিয়-মকর টেকটোনিক প্লেট নামে পরিচিত এই ফলকটি ভাঙছে প্রায় এক বছরে ০.০৬ ইঞ্চি (১.৭ মিলিমিটার) করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, ১ মিলিয়ন বছরে ফলকটির দুই অংশ বর্তমান সময়ের চেয়ে নিজেদের থেকে প্রায় ১ মাইল (১.৭ কিলোমিটার) দূরে থাকবে।
সহ-গবেষক অরেলি কৌডেরিয়ার-কারভেয়ার বলেন, “এটি খুব দ্রুত গতিশীল এমন কোন গঠন না, কিন্তু গ্রহের অন্যান্য সীমানার তুলনায় এটি এখনো তাৎপর্যপূর্ণ”। তিনি প্যারিসের আর্থ ফিজিক্স ইন্সটিটিউট অফ মেরিন জিওসায়েন্সের একজন সিনিয়র গবেষণা ফেলো।
![]() |
উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের ডেড সি ফল্টটির ভাঙনের গতি এই হারের চেয়ে দ্বিগুণ, অথবা বছরে ০.২ ইঞ্চি (০.৪ সেন্টিমিটার), যেখানে ক্যালিফোর্নিয়ার সান আন্দ্রেস ফল্টটি ১০ গুণ দ্রুত ভাঙছে যা বছরে প্রায় ০.৭ ইঞ্চি (১.৮ সেন্টিমিটার)।
প্লেটটি এতটাই ধীরগতিতে বিচ্ছেদ হচ্ছে এবং এটি পানির এত নীচে যে গবেষকগণ “নাসেন্ট প্লেট বাউন্ডারি” বলে যেটাকে জানতেন সেটাকেই মিস করে গেছেন। কিন্তু দুটি সাংঘাতিক সংকেত – ভারতীয় মহাসাগরের একটি অদ্ভুত স্পটে দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎপত্তি – ধারণা দেয় যে পৃথিবী পরিবর্তনকারী শক্তিগুলো আগে থেকেই ছিল।
এপ্রিল ১১, ২০১২ এ ৮.৬ মাত্রা এবং ৮.২ মাত্রার দুইটি ভূমিকম্প ইন্দোনেশিয়ার কাছে, ভারত মহাসাগরের নিচ দিয়ে আঘাত হানে। ভূমিকম্পটি সাবডাকশন জোনে ঘটেনি, যেখানে একটি টেকটোনিক প্লেট অন্য আরেকটির নিচে স্লাইড করে। তার পরিবর্তে, এই কম্পনগুলো একটি উদ্ভট জায়গায় উৎপন্ন হয়েছে – ফলক বা প্লেটের মাঝখানে।
এই ভূমিকম্পগুলো ও অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক ইংগিতগুলো নির্দেশ করে যে, এরকম বিকৃতি ভূগর্ভস্থ অনেক দূর পর্যন্ত ‘ওয়ারটন বেসিন’ নামে পরিচিত এমন এক অঞ্চলেও ছড়িয়ে গেছে।
এই বিকৃতি পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিল না; ভারত–অস্ট্রেলিয়া–মকরক্রান্তি প্লেট কোনও সম্মিলিত একক নয়।
“এটা একটা ধাঁধার মতো”, কৌডেরিয়ের-কারভেওর লাইভ সাইন্সকে বলেন। “এটি একইরকম ফলক নয়। এখানে তিনটি ফলক আছে যেগুলো কম-বেশী নিজেদের সাথে যুক্ত থাকে এবং একই দিকে একই সাথে এগিয়ে চলছে” জানান তিনি।
গবেষণাকারী দলটি ওয়ারটন বেসিনের ফ্র্যাকচার জোনের দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন যেখান থেকে ভূমিকম্পগুলোর উৎপত্তি ঘটেছিল। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে গবেষণা জাহাজের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের দ্বারা সংগৃহীত দুটি ডেটাসেট ফ্র্যাকচার জোনের টপোগ্রাফীকে প্রকাশ করে।
![]() |
পাঠানো শব্দ তরঙ্গগুলোর পলল-রেখাযুক্ত সামুদ্রিক মেঝে এবং নিচের কোমল স্তরের নিম্নবর্ত্তী শক্ত নিরেট পাথর থেকে ফিরে আসতে কতক্ষণ সময় লাগে সেটার ওপরে ভিত্তি করে জাহজের বিজ্ঞানীরা বেসিনের মানচিত্র বানাতে সক্ষম হন। (গবেষণাটির সহ-লেখক সতীশ সিংহ, সিঙ্গাপুরের আর্থ অবজারভেটরির সিসমোলজির পরিদর্শন অধ্যাপক, ২০১৫ সালের ডেটাসেটের জন্য এই অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।)
যখন কৌডেরিয়র-কারভেয়র এবং তার সহকর্মীরা ডেটাসেটগুলোর দিকে নজর দিচ্ছিলেন তখন তারা পৃথক হয়ে যাওয়ার স্বপক্ষে প্রমাণ পান, যেগুলো স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্টে নিম্নচাপ গঠন করে। সবচেয়ে বিখ্যাত স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট সম্ভবত স্যান আন্দ্রিয়াস ফল্ট। যখন পৃথিবীর দুটি ব্লক অনুভূমিকভাবে একে অপরকে অতিক্রম করে তখন এই রকমের ফল্টগুলি ভূমিকম্পের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি কল্পনা করার একটি ভাল উপায় হচ্ছে, আপনার দুই মুঠো একসাথে রাখা এবং তারপর একটি এগিয়ে নিয়ে এবং অন্যটি পিছন দিয়ে চলে যাওয়া।
লক্ষণীয়ভাবে, দলটি ম্যাপযুক্ত ফ্র্যাকচার জোনের পাশের ৬২টি পৃথক হওয়া বেসিনের সন্ধান পেয়েছে , যা প্রায় ২১৭ মাইল (৩৫০ কিলোমিটার) দৈর্ঘ্যের বেশী, যদিও এটি সম্ভবত দীর্ঘতর, কৌডেরিয়ের- কারভেওর বলেন। এই অববাহিকা বা বেসিনগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশাল ছিল – ১.৮ মাইল (৩ কিমি) প্রশস্ত এবং ৫ মাইল (৮ কিমি) দীর্ঘ।
এমনকি, দক্ষিণে নিম্নচাপগুলো আরো গভীর ছিল- ৩৯৪ ফুট (১২০ মিটার) এর মতো গভীর- এবং উত্তরে অগভীর – ১৬ ফুট (৫ মিটার) পর্যন্ত অগভীর।
এর অর্থ এই হতে পারে যে এই স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট এর দক্ষিণ সীমানায় আরও স্থানীয়করণ হয়েছে, অন্তত এখনের জন্য- কৌডেরিয়র- কারভেওর বলেন। “স্থানীয়করণ” শব্দের অর্থ হল একটি মূল ফল্টে কম্পন ঘটেছে, বনাম যখন কম্পনগুলো অনেকগুলো মাইনর ফল্টে ঘটে থাকে সেটা হচ্ছে “বিতরণ”।
![]() |
প্রায় ২.৩ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি হওয়া এই অববাহিকাগুলি এমন একটি রেখা অনুসরণ করেছিল যা ২০১২ সালের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলগুলির কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।
গবেষণাটিতে জড়িত নয়, নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্ট-দোহার্টি আর্থ অবজারভেটরির সিসমোলজিস্ট উইলিয়াম হাওলি লাইভ সায়েন্সকে বলেছেন, “এটি এখনও পুরোপুরি গঠিত প্লেট সীমানার মতো বলে মনে হচ্ছে না।” “তবে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মতো বার্তা হচ্ছে, এটি এক হয়ে যাচ্ছে এবং সম্ভবত আমাদের জানা বেশীরভাগ বিকৃতির জন্য এটি দায়ী”
ফল্টটি সেখানে কেন?
কৌডোরিয়র-কারভেওর উল্লেখ করেছিলেন যে, ফ্র্যাকচার অঞ্চলটি যা মহাসাগরীয় ভূত্বকের একটি দুর্বলতা, ভূমিকম্পের কারণে তৈরি হয়নি। বরং, এই তথাকথিত প্যাসিভ ফাটলগুলি একটি অংশে গঠিত হয়েছিল, যখন মধ্য মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে নতুন মহাসাগরীয় ভূত্বক উত্থিত হয় (প্লেটগুলির মধ্যে সীমানা যেখানে ম্যাগমা বেরিয়ে আসে) এবং পৃথিবীর বক্রতার কারণে সেখানে ফাটল ধরে।
এখন এই ফ্র্যাকচার অঞ্চলটি পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। “প্রকৃতি তার দুর্বলতাকে ব্যবহার করতে পছন্দ করে, যা ইতোমধ্যেই নিজের কাছে আছে তা ব্যবহার করাটাই তার পছন্দ”,জানান কৌডোরিয়র-কারভিওর।
তিনি বলেন, ভারত-অস্ট্রেলিয়া-মকর অঞ্চলের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন গতিবেগে চলছে, এই ফ্র্যাকচার অঞ্চলটি একসময় শুধু একটি প্যাসিভ ক্র্যাক ছিল, যা এখন প্লেটের বিভক্ত হয়ে দুটি টুকরো হয়ে যাওয়ায় তাদের নতুন সীমানা হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুনঃ ১। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে যুদ্ধ করতে কার্বন সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্র! |
তবে, যেহেতু ভারত-অস্ট্রেলিয়া-মকর প্লেটের বিভাজনটি এত ধীরে ধীরে ঘটছে, সেহেতু এই বিশেষ ফল্টের মধ্যে আরও একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প সম্ভবত ২০,০০০ বছর এর আগে ঘটবে না, গবেষকরা বলেছেন। আরও কি, বিভাজনটি সম্পূর্ণ হতে কয়েক মিলিয়ন বছর সময় নিবে, কৌডোরিয়র-কারভিওর জানান।
“এটি দীর্ঘকাল হতে অনুমান করা হচ্ছিল যে এই দুর্বলতার (ফ্র্যাকচার) অঞ্চলগুলোর জন্মস্থল নতুন প্লেট বাউন্ডারি যেমন সাবডাকশন অঞ্চল বা স্ট্রাইক- স্লিপ সীমানা গঠন- এমন হতে পারে”, বলেন অলিভার জাগাউটজ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ভূতত্ত্বের সহযোগী অধ্যাপক।
“প্লেটগুলি ক্রমাগত পৃথিবীতে গঠিত এবং ধ্বংস হয়”, জাগাউটজ একটি ইমেইলে লাইভ সায়েন্সকে জানিয়েছেন। “এই পর্যবেক্ষণটির বিশদ তথ্য আমাদেরকে কিভাবে প্লেটের জিগস্যও পাজল পৃথিবীর বহিঃস্থতম শক্ত স্তর গঠন করে এবং বিকশিত করে তা আরো ভালভাবে বুঝতে সহায়তা করে।”
গবেষণাটি অনলাইনে জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস নামক জার্নালে ১১ই মার্চ প্রকাশিত হয়।
নাহিদ সুলতানা তুলি/ নিজস্ব প্রতিবেদক
![]() |