নাসের(ছদ্মনাম) এইচএসসি পড়ুয়া এক তরুণ,মোটামুটি ভালো ছাত্র হিসেবে খ্যাতি ছিলো তার। সারাদিন কোচিং, ক্লাস-পরীক্ষার ধকল শেষ করে রাতের কিছুটা অবসরে বিশেষ বন্ধুর সাথে খানিকটা গল্প, এভাবেই দিনশেষে ক্লান্তি আর অবসাদের পর প্রিয়জনের সংস্পর্শে পূর্ণ হতো তার সারাদিনের রুটিন। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার এইচএসসি পরীক্ষা, পাল্লা দিয়ে বদলে যেতে থাকে তার চেনা সেই প্রিয়জন। দিনশেষের সেই ক্লান্তির প্রহর গোণা শেষে প্রিয়জন আর আসেনা।
সেই সময় প্রচন্ড মানসিক হতাশা আর দুঃখকে পাশ কাটাতে কতিপয় বন্ধুর পরামর্শে সে হাতে তুলে নেয় ১২০ মিলিমিটার দৈর্ঘ্য এবং ব্যাস ১০ মিলিমিটার ব্যাসের এক অস্ত্র। এই অস্ত্র কখনো শব্দ করেনা, শুধু সাময়িক সমস্যা গুলো নিয়ে মস্তিষ্ককে ভাবা বন্ধ করতে সাহায্য করে। নিউটনের ৩য় সূত্র অনুসারে সকল ক্রিয়ারই রয়েছে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া বলটি ছিলো তার হাসিখুশি জীবন নষ্টের অভিসম্পাত। অতিরিক্ত মাত্রায় নিকোটিন গ্রহণের ফলে তার মোটর নিউরন কার্যক্রম দিন দিন দূর্বল হয়ে পড়ে। যার ফলে জীবনের সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ পরীক্ষায় সে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও লিখতে পারেনি, যার ফল স্বরূপ ধোঁয়ার মতোই ঢেকে যায় তার জীবন।
উপরের ঘটনাটি ছোট হলেও, আমাদের বেশ পরিচিত। আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। প্রতিবছর ৩১শে মে সারা বিশ্বে এ দিবস পালিত হয় ধূমপানের বিরুদ্ধে সকলকে সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যে। দিবসটির এবারে প্রতিপাদ্য হলো, “তামাক কোম্পানির কূটচাল রুখে দাও, তামাক ও নিকোটিন থেকে তরুনদের বাঁচাও”। আজ এই দিবসে জেনে নিই ধূমপানের ক্ষতিকর দিক গুলো, এবং সচেতন হই।
ধীরে ধীরে পৃথিবীতে বাড়ছে তামাক সেবনকারীদের সংখ্যা। ঠিক কি কারণে মানুষ তামাকের প্রতি আকৃষ্ট হয়, এর গবেষণায় আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি জানায় সাধারণত হতাশা, বেকারত্ব, প্রিয়জনের মৃত্যু, কিংবা মানসিক চাপ হতে মুক্তি পেতে বেশীরভাগ তরুণ হাতে তুলে নিচ্ছে তামাক।২০১৪ সালে প্রকাশিত সার্জন জেনারেল রিপোর্ট(SGR) অনুযায়ী ১০ জনের মধ্যে ৯ জন ধূমপায়ী সিগারেট এর সাথে পরিচিত হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই।২৬ বছর হওয়ার আগেই মোটামুটি সবাই এই তামাকটি একবার হলেও গ্রহণ করে থাকে।
সিগারেট সেবন প্রক্রিয়া একটি শিকলবদ্ধ প্রক্রিয়ার মতোই। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির মতে, যেসকল তরুণদের পরিবারের সদস্য বা আত্বীয় ধূমপায়ী তারা ৭০-৯০% একই নেশায় আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে অন্যদের চেয়ে। এছাড়াও বন্ধু সমাজে নিজেকে আধুনিক, স্মার্ট বলে দাবি করতেও অনেক বেছে নিচ্ছে এই তামাক।
এ ক্ষেত্রে তামাক সেবনের প্রথম পদক্ষেপটি আসে নিকট বন্ধুদের কাছ থেকেই। যেমন আমাদের প্রেক্ষাপটেই ধরা যাক, কোন কাজে ব্যর্থ হলে সেই ব্যর্থতার হতাশাকে ভুলতে বন্ধু ভালোবাসে সিগারেট ধরিয়ে দেয়। সে শুধু আপনাকে হতাশা থেকেই সরাচ্ছে না; সেই সাথে আপনাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে ধোঁয়াটে এক ভবিষ্যতে।
আমেরিকান ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (FDA) এর এক গবেষণায় দেখা যায়, ধূমপায়ী ব্যক্তির ফুসফুসের নিকোটিন গ্রহণের ক্ষমতা অধূমপায়ী থেকে অনেক বেশী। সাধারণত যেসকল ব্যক্তি ধূমপান করেন না তাদের ফুসফুসে প্লুরা নামক আবরণ থাকে যা শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া কে নিয়মিত এবং বাতাসে থাকা বিভিন্ন কণিকা ছাঁকনে ফিল্টার হিসেবে কাজ করে থাকে।
কিন্তু সবচাইতে দুঃখজনক, ধূমপায়ী ব্যক্তি নিয়মিত ১৫-২০ বার ধূমপান করার ফলে এই স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এবং একটি সময় তা চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ধূমপায়ী ব্যক্তি ধূমপান পরিহার করার পরও আশেপাশের ব্যক্তির ধূমপান করার ফলে সেই ব্যক্তির ফুসফুস তূলনামূলকভাবে বেশী হারে নিকোটিন গ্রহণ করতে থাকে।
সাধারণত একটি সিগারেটে নিকোটিন এর মাত্রা হলো ৮ মিলিগ্রাম/শলাকা, এর মধ্যে ১-২ মিলিগ্রাম শুধু একজন ধূমপায়ী গ্রহণ করে থাকেন। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্র্যান্ডের সিগারেটে এই নিকোটিন এর মাত্রা গিয়ে দাঁড়ায় ১০০-২০০ মিলিগ্রামে যা থেকে আনুপাতিক হারে তূলনামূলক বেশী নিকোটিন পেয়ে থাকেন গ্রহণকারী। যা ধীরে ধীরে তার ফুসফুসকে অকার্যকর করে দেয়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তামাকমুক্ত দিবস নিয়ে এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তরুণ প্রজন্মের তামাকের আসক্তির বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখে তামাক উৎপাদনকারীরা প্রতি বছর মিলিয়ন ডলার খরচ করে থাকে ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রচারণা ও টিভি বিজ্ঞাপন দিতে। যা তরুণ প্রজন্মের সুস্ঠ বিকাশে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ।
তাঁদের প্রতিবেদনে আরো দেখা যায় প্রতিবছর ধূমপানজনিত কারণে মৃত্যু হয় প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষের যার মধ্যে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষই সরাসরি তামাকজাত পণ্য (সিগারেট, গাজা) সেবনকারী এবং সবচাইতে ভয়ংকর হচ্ছে বাকি প্রায় ১০ লাখ মানুষ সিগারেট সহ তামাকজাত পণ্য সেবনকারীর সংস্পর্শে থাকার কারণে মৃত্যুবরণ করে। তাই একজন সিগারেট সেবনকারী শুধু নিজেকেই নয় বরং পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে অকাল মৃত্যাুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
তামাকজাত পণ্য সেবন ও প্রতিরোধ বিষয়ে সার্জন জেনারেল রিপোর্ট (২০১২) এর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা যায় প্রতি ৩ জন ধূমপায়ী বা তামাক গ্রহণকারীর একজন তামাকগ্রহণ করার নেশা কাটিয়ে উঠতে পারে এবং বাকি দুজনের মাঝে একজন অকালেই মৃত্যুবরণ করে বাকি একজন ফুসফুস সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করে।
এছাড়াও যারা সিগারেট বা তামাকজাত পণ্য গ্রহণ করাকে ট্রেন্ড হিসেবে ধরে নিয়েছিলো তাদের ৯০% শতাংশই তাদের ভুল বুঝতে পারে। কিন্ত সবচাইতে দুঃখের বিষয় তাদের ফিরে আসা কিংবা সুস্থ থাকার সুযোগ তখন আর থাকেনা। এছাড়াও প্রতিবেদটি অনুসারে পৃথিবীতে তামাকজাত পণ্য তৈরী-উৎপাদন এর দুই-তৃতীয়াংশই হয়ে থাকে তৃতীয় বিশ্বের মতো আর্থিক সক্ষমতায় নাজুক দেশগুলোতে।
এতো এতো তথ্য জানার পর যদি আপনার মনে হয়, হ্যাঁ সময় এসেছে বদলানোর, তবে আপনাকে ২০২০ সালের এই দিনটির পর নতুন একটি দিনে স্বাগতম!! মনে রাখবেন সিগারেট কিংবা ধূমপায়ী ব্যাক্তি কেবল নিজের নয় পরিবারের সবচাইতে ছোট্ট শিশুর রক্তেও মিশিয়ে দিচ্ছে নিকোটিন। ধূমপায়ী কিংবা তামাকজাত পণ্য গ্রহণকারী ব্যাক্তি কখনোই প্রিয়জনের অতি সংকাটাপন্ন মুহূর্তে রক্ত কিংবা বিভিন্ন শারীরিক অঙ্গ দান করতে পারেন না।
তাই যদি প্রিয়জনকে বাঁচাতে চান আজই তামাকজাত পণ্যকে না বলুন এবং সতর্কতা সচেতনতা গড়ে তুলুন। সব শেষে জিম্বাবুয়ের স্বৈরশাসক রবার্ট মুগাবে- এর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি। তার মতে সিগারেট হলো এমন এক জ্বলন্ত দন্ড যার একপ্রান্তে থাকে আগুন অন্য প্রান্তে একটা গাধা। তাই ভাবার সময় এখনই, গাধা হয়ে বাঁচবেন নাকি একজন সচেতন মানুষ হয়ে?
এ এন এম নাঈম/ নিজস্ব প্রতিবেদক