দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রুপে তান্ডব চালিয়ে মূল ভূখন্ডে গভীর স্থল নিম্নচাপ রূপে প্রবেশ করে আম্ফান। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবর অনুসারে ঘূর্ণিঝড়টি রাজশাহী-রংপুর বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের ফসলের ক্ষয়ক্ষতি করে দূর্বল লঘুচাপে পরিণত হয়েছে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতায় এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের দেশে হয়তো কারো বাসার বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, কারো বা বাসায় পানি ছিল না; সবচেয়ে বাজে অবস্থা হয়েছে তাদের যাদের বাসা বাড়ির চাল বা ছাদ উড়ে গেছে, কিংবা বাসার কিছু অংশ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ। ঝড়ের ফলে উপকূলের বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির সংবাদও পাওয়া গেছে কিছু কিছু মাধ্যম থেকে। আসলে সত্য বলতে কি, এসব খুব যে বড় ক্ষতি তাও না, হয়তো সময় পেলে এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু আমাদের নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করা উচিত, কারন আমাদের যে সম্ভাব্য ক্ষতি হতে পারতো সেগুলো হয়নি। না,আমরা কোন মানুষ হারাইনি, আমাদের ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর বিশাল কোন ধ্বংসযজ্ঞ চলেনি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্ত আপনাদের কি একবারও মনে হচ্ছেনা কেন এরকম হয়নি, কেনই বা এত বড় ঝড়ের সামনে থেকেও যে ক্ষতি আশংকা করা হয়েছিল, তার খুব সামান্যই হয়েছে? এর কারণ আসলে আমরা খুব ভাগ্যবান, আমাদের কাছে আছে প্রকৃতির এক অসামান্য উপহার, হ্যা আমাদের সুন্দরবন। ১৩৯৫০০ হেক্টর অঞ্চল জুড়ে বিস্তীর্ণ এ বনভূমি শুধু দুটো দেশের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা সেখানে থাকা জনবসতির জীবনধারণের উপায় বা রয়েল বেঙল টাইগারের বাসস্থানই শুধু নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবন সকল ঝড় জলচ্ছাসের বিরুদ্ধে চোখের আড়ালে থাকা প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। বরাবরের মতো এবারও সুন্দরবন আমাদেরকে রক্ষা করেছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান-এর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে।
আচ্ছা, প্রশ্ন আসতেই পারে, ঘুর্ণিঝড় তো স্থলভাগে আসলেই দূর্বল হয়ে পড়ে, তবে সুন্দরবনকেই কেন প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ বা এই জাতীয় উপাধি দিয়ে আসা হচ্ছে? প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে, ভারতের তামিওনাড়ু অঞ্চলে আঘাত হানে এক সুপার সাইক্লোন। তবুও দেখা যায়, পিচাভরম এবং মুথুপেট অঞ্চলে সবচেয়ে কম ক্ষতি করে। কেন জানেন? কারণ সেই অঞ্চল ছিল ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ঢাকা। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানি স্বামীনাথন, যিনি MSSRF এর প্রধান, বলেন, “আমরা দেখেছি, এই রকম ম্যানগ্রোভ বন অনেকটা বেল্টের মত কাজ করে, ফলে সুনামি বা ঘূর্ণিঝড়ের প্রথম ধাক্কাটা এরাই সহ্য করে।”
আসলে ঘূর্ণিঝড় যখন সামনের দিকে অগ্রসর হয়, তখন নির্দিষ্ট শক্তি নিয়ে এগুতে থাকে। খোলা ভুমিতে আসা মাত্র এটা সঞ্চয় করা শক্তির সমস্তটুকু দিয়ে সামনে থাকা বস্তুটিকে আঘাত করে। ম্যানগ্রোভ বন এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এতে থাকা বড় গাছ এবং ডালপালা খুব ঘনভাবে নিজেদের ভেতর বিন্যস্ত থাকে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঘনভাবে বিন্যস্ত কিছুতে আঘাত করলে বা সরানোর চেষ্টা করলে বেশি শক্তি ব্যয় হয়। তাই দেখা যায়, সুন্দরবনের উপর দিয়ে যাবার সময় বাতাসের গতিবেগ হঠাৎ করে একটা নির্দিষ্ট হারে কমতে থাকে, যা সাধারণ স্থলভাগে অসম্ভব। তাই আমাদের দিকে ধেয়ে আসা যেকোনো ঘুর্ণিঝড়ের প্রাথমিক ধাক্কা সুন্দরবনের উপরেই পড়ে বলে ক্ষতি সেখানেও হয় বেশি। কিন্তু প্রতিবারই সুন্দরবন নিজের ক্ষয়ক্ষতির পরেও রক্ষা করে যাচ্ছে আমাদেরকে।
ঋভু/ নিজস্ব প্রতিবেদক
+1
+1
+1
+1
+1
+1
+1