ব্ল্যাকহোল মহাকাশে কখনোই স্থির থাকে না৷ তারা তাদের গতিশীলতার মাধ্যমে সবসময় কর্মক্ষম থাকে, তবে তারা এতো ঘন কালো যে তাদের সহজে পর্যবেক্ষণ করা যায়না! অবশেষে বিজ্ঞানীরা দুই বৃহৎ ব্ল্যাকহোলের মধ্যে এক ‘অদ্ভুত নৃত্য ‘- এর সঠিক সময়সীমা বের করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত ব্ল্যাকহোলগুলোর মধ্যে ওজে-২৮৭ গ্যালাক্সির সবচেয়ে বড় ব্ল্যাকহোল, যার ভর সূর্যের চেয়ে ১৮০ কোটি গুণ বেশি। আবার এই ব্ল্যাকহোলকে কেন্দ্র করে আরো একটি ব্ল্যাকহোল চারপাশ প্রদক্ষিন করে যার ভর সূর্যের চেয়ে ১৫ কোটি গুণ বেশি।
অপেক্ষাকৃত ছোট এই ব্ল্যাকহোলটি ১২ বছরে ২ বার বৃহৎ ব্ল্যাকহোলের সাথে সংঘর্ষিত হয়। সংঘর্ষের ফলে আলোর ঝলকানি উৎপন্ন হয়। এটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্যে এতোটাই উজ্জ্বল যে, এই আলো পৃথিবীতে আসতে ৩৫০ কোটি বছর লেগে যাবে।
তবে ছোট এই ব্ল্যাকহোলটির কক্ষপথ গোলাকার নয়, অনেকটা আয়তাকার৷ যখন সংঘর্ষ সংঘটিত হয়, ছোট ব্ল্যাকহোলটি গরম গ্যাসের দুইটি প্রসারিত বাবল তৈরী করে, যা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে চারভাগে পরিণত হয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি ঔজ্জ্বল্য সৃষ্টি করে।
অনিয়মিত কক্ষপথের কারনে ব্ল্যাকহোলটি বারো বছরে বিভিন্ন সময়ে গ্যাসসমষ্টির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়৷ কখনো কখনো সংঘর্ষ এতোটাই স্বল্প পরিসরে হয় যে, এটি বছরে একবার সংঘটিত হতে পারে। কখনো বা দশ বছর পর পর হতে পারে। এটি পুরোটাই কক্ষপথের আকারের উপর নির্ভর করে। ২০১০ সালে বিজ্ঞানীরা কক্ষপথের একটি মডেল তৈরী করেন, যার মাধ্যমে সংঘর্ষটি ঘটার ১-৩ সপ্তাহের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাব্য ধারণা দিতে পারত। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ঘটা এক সংঘর্ষের সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করার মাধ্যমে তাদের মডেলের যথার্থতা প্রমাণিত হয়।
২০১৮ সালে ভারতের টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের লংকেশ্বর দে–এর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত করেন যার মাধ্যমে এই মডেলের আরো বিস্তারিত ধারনা দেওয়া হয় এবং চারঘন্টার মধ্যে এই সংঘর্ষের সময়সীমা বের করা সম্ভব। ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই সংঘটিত এক সংঘর্ষের মাধ্যমে তাদের মডেলের যথার্থতা প্রমাণিত হয়।
তবে এই সংঘর্ষ এখনও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি, কেননা পৃথিবী থেকে ওজে-২৮৭ গ্যালাক্সির বিপরীত দিকেই সূর্য। পৃথিবীর কক্ষপথে ও ভূমিতে স্থাপন করা টেলিস্কোপে ব্ল্যাকহোল চোখে পড়ছিলো না। দীর্ঘদিন পর সংঘর্ষটি ক্রমশ দূর্বল হতে থাকে কিন্তু তখন সেটি নাসার স্পিটজার স্পেস টেলিস্কোপে ধরা পড়ে।
দীর্ঘ ১৬ বছর প্রচেষ্টার পর, এই টেলিস্কোপটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫৪ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে স্থাপন করা হয়, এই দূরত্ব পৃথিবী থেকে চাঁদের মধ্যবর্তী দূরত্বের প্রায় ৬০০ গুণ। এই সুবিধাজনক অবস্থান থেকে স্পিটজার পুরো সিস্টেমকে পর্যবেক্ষণ করতো। তার পর্যবেক্ষণের সময়সীমা ছিল ৩১ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, কেননা ধারনা করা হচ্ছিল ৩১ জুলাইয়ের দিকে সংঘর্ষটি সংঘটিত হবে এবং ওজে-২৮৭ কে পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
স্পিটজারের পর্যবেক্ষণ পৃথিবী থেকে তত্ত্বাবধান করা স্যাপো লেইন, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এর ভাষ্যমতে, ‘যখন ওজে-২৮৭ এর প্রথম দেখতে পাই, আমি অবাক হই যে যেদিন সংঘর্ষটি ঘটে, স্পিটজারে সেদিনই সেটির দেখা মিলছে। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম, কেননা আমরা সেই সংঘর্ষের মাত্রা স্পিটজার দিয়ে নির্দিষ্ট বিন্দুতে নির্নয় করতে পেরেছি, এর আগে মানবসৃষ্ট কোনো যন্ত্রই এটা করতে পারেনি। ‘
বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের কিছু ছোট ছোট বস্তুর কক্ষপথের মডেল তৈরী করছেন, যেমন একটি ধুমকেতু, যেটি সূর্যের চারদিকে ঘুরে।তার ঘূর্ণন ক্ষমতা অনেকগুলো কারনের উপর নির্ভর করে। সূর্যের মহাকর্ষ বল সেই ধুমকেতুটির প্রধান বল হলেও আশেপাশের গ্রহের মহাকর্ষ বল ধুমকেতুর পথ পরিবর্তন করতে পারে।
দুইটি বৃহৎ ব্ল্যাকহোলের গতিপথ বের করা খুবই জটিল ব্যপার। বিজ্ঞানীরা সেইসব কারনগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন যেগুলো ছোট বস্তুর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলে না। এর মধ্যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ প্রধান। আইন্সটাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র অনুসারে ১৯১৬ সালে এর তাত্ত্বিক অস্তিত্ব মিললেও ২০১৫ সালের আগে সেটি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। (লাইগো(LIGO) প্রজেক্ট)
বস্তুর ভর যতো বেশি হবে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ততো বেশি তৈরী হবে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, ওজে-২৮৭ এর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এত বেশি হবে যেন এটি ছোট বস্তুর কক্ষপথ পরিবর্তন করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি ধারন করতে পারে, যার কারনেই মূলত সংঘর্ষের সূত্রপাত।
ওজে-২৮৭ কে নিয়ে পূর্ববর্তী গবেষণাগুলো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নির্ভর হলেও ২০১৮ সালে উপস্থাপিত মডেলটি আরো বেশি বিস্তারিত ও গ্রহনযোগ্য। লাইগো থেকে নির্নয় করা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সামগ্রিক তথ্যগুলো নিয়ে তৈরী করা এই মডেলটির মাধ্যমে সংঘর্ষটি হবার ১ বা ১/২ দিন আগেই ধারনা করা যায়। এই মডেলের উপর ভিত্তি করে ব্ল্যাকহোলের ‘no hair’ তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৬০ সালে একদল পদার্থবিদ, যেখানে স্টিফেল হকিংও যুক্ত ছিলেন, একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, যেটির সাহায্যে ব্ল্যাকহোলের পৃষ্ঠের অবস্থা অনুমান করা যায়। যদিও ব্ল্যাকহোলের সত্যিকার অর্থে কোনো পৃষ্ঠ নেই, তবে বিজ্ঞানীরা ধারন করছেন ব্ল্যাকহোলের চারপাশের একটি সীমানা রয়েছে যার মধ্য দিয়ে কোনকিছুই, এমনকি আলোও বের হতে পারবেনা। এই সীমান্তকে বলা হয় ঘটনা দিগন্ত।
এই সীমান্ত প্রয়োজনে পরিবর্তিত হতে পারে। অন্যভাবে বললে কেউ যদি ব্ল্যাকহোলের এর ঘূর্ণন অক্ষ বরাবর ভাগ করে, তবে এর পৃষ্ঠ হবে প্রতিসম। মূলত ওজে-২৮৭ ব্ল্যাকহোলটি, ব্ল্যাকহোলের পৃষ্ঠের প্রতিসাম্যতার তত্ত্বটির প্রমাণ দেয়।
ইকবাল হোসেন নাফিজ / নিজস্ব প্রতিবেদক