১৫ জন অসাধারণ নারী যারা চাঁদে অ্যাপোলো মিশনকে সম্ভব করে তুলেছিলেন:
নাসার অ্যাপোলো মিশন আজ থেকে ৫০ বছর আগে মহাকাশচারীদের চাঁদে নামিয়েছিল। কোন নারী দৃশ্যত চাঁদে নামেননি কিন্তু তারা ছিলেন পর্দার আড়ালে সব ধরনের যান্ত্রিক বা পরিকল্পনা কাজে, যা এই মিশনকে সফলতার পথ দেখিয়েছে। তারা কন্ট্রোল রুম, ফ্লাইট সফটওয়্যার তৈরি, ব্যাকআপ প্ল্যান তৈরি সবকিছুতেই ভূমিকা রেখেছিলেন।
যখন ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমেরিকা চাঁদে পা রাখার অভূতপূর্ব ও গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবে তখন তিনি শুধুমাত্র পুরুষদের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
কেনেডি বলেছিলেন-“আমি বিশ্বাস করি এই জাতি অবশ্যই নিজেকে এ লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত হবে, চাঁদে মানুষের অবতরণ এই দশক শেষ হবার আগেই হবে” –
মহাকাশ যাত্রার ইতিহাসবিদ এবং লেখক আমি শিয়েরা তেঁতেল বলেছিলেন, “সে সময়ে মহাকাশ যাত্রার জন্য শুধুমাত্র পুরুষদের বাছাই করার একটা খুব সাধারন কারণ ছিল। যখন নাসা মহাকাশচারীদের প্রথম গ্রুপ নিয়োগ করছিল, তখন ও তারা জানত না আসলে কি কারণে তাদেরকে নিয়োগ করা হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ ধারণা করেছিল পরীক্ষামূলক বৈমানিক বা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সামরিক পাইলটরা এই কাজের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত হবে।আর স্বাভাবিকভাবেই সে সময়ে সামরিক পাইলটরা সবাই পুরুষ ছিলেন। তখন তারাই মহাকাশে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম এ ব্যবহৃত হয়েছিলেন।”
কিন্তু তখন নারীরাও এই এ্যাপোলো প্রোগ্রামের সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।তেঁতেল বলেন, “নারীরা এমন সবগুলো কাজ করেছে যা সরাসরি চাঁদে যায়নি, কিন্তু এই মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো”।
এখানে এমন ১৫ জন নারীর কথা দেওয়া হলো যারা আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ২০ জুলাই, ১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষের অবতরণকে সম্ভব করে তুলেছিলেন।
বিয়ট্রিস হিকস :
এ্যাপোলো মিশনের কয়েকবছর আগে বিয়ট্রিস হিকস (Beatrice Hicks) জটিল গ্যাস ঘনত্ব সেন্সর আবিষ্কার করেন যা মহাকাশ ভ্রমনকে সম্ভব করে তুলেছে।
নাসা এই পদ্ধতিকে স্যাটার্ন–ভি রকেটে ব্যবহার করেছিলো যা এ্যাপোলো মিশনে উৎক্ষেপিত হয়েছিলো। নিজের ফ্যাক্টরিতে বিয়ট্রিস হিকস (১৯৫৬ সালের কাছাকাছি সময়ে)
ন্যাশনাল ইনভেন্টরস হল অফ ফেমের মতে, হিকস এর আবিষ্কৃত এই সেন্সর বর্তমানে বোয়িং–৭০৭ বিমানে, স্টোরেজে থাকা পারমানবিক অস্ত্র মনিটর করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি ১৯৫০ সালে “সোসাইটি অফ উইমেন ইঞ্জিনিয়ারস” এর সহ–প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
ইলিনর ফোরকার :
মহাকাশচারীদের ধাতু ও প্লাস্টিক নির্মিত পোশাকগুলো ইলিনর ফোরকার (Eleanor Foraker) ও তার সহোযোগীরা হাতে সেলাই করেছিলেন। ITC (International Latex Corporation), Dover এর একজন কর্মী অ্যালুমিনাইজড প্লাস্টিকের কয়েকটি স্তর একত্রে সেলাই করছেন, যা নাসার এ্যাপোলো প্রোগ্রামে মহাকাশচারীদের পোশাকে ব্যবহৃত হয়েছিলো।
CBS News অনুসারে, “প্রতিটি স্পেসস্যুট গসমার–পাতলা (Gossamer–thin) কাপড়ের ২১ টি স্তর একত্রে সেলাই করে তৈরি করা হয়েছিলো। ইলিনর ফোরকার ছিলেন ITC এর একজন পুরোনো ও অভিজ্ঞ কর্মী। তিনি বলেছিলেন, ” আমি ফ্যাক্টরির উদ্দেশ্যে ভোর ৫ টায় বের হতাম এবং সন্ধ্যা ৭ টায় ঘরে ফিরতাম, কিন্তু আমার পরিশ্রম সার্থক”। তিনি সপ্তাহে প্রায় ৮০ ঘন্টা কাজ করতেন, টানা ৩ বছরের জন্য কোনো ছুটি পাননি এবং ২ বার নার্ভাস ব্রেকডাউনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন। পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য এ্যাপোলো মহাকাশচারীদের ব্যবহৃত প্যারাসুটও হাতে বানানো ছিলো।
মার্গারেট হ্যামিল্টন :
মার্গারেট হ্যামিল্টন (Margaret Hamilton) এ্যাপোলো মিশনের উড্ডয়নকালীন কম্পিউটার সিস্টেম তৈরিকারী দলের প্রধান ছিলেন। মার্গারেট হ্যামিল্টন, গণিতবিদ ও কম্পিউটার প্রোগ্রামার, এম আই টি ইন্সট্রুমেন্টেশন ল্যাবের এ্যাপোলো কমান্ড মডিউলের মক–আপে বসে আছেন (নভেম্বর ২৫, ১৯৬৯)
হ্যামিল্টন সম্প্রতি বলেছেন, ” এ্যাপোলো মিশনের শুরুর দিকে সফটওয়্যারকে অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নেওয়া হয়নি। আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য প্রয়োজনীয় মর্যাদা পাচ্ছিলাম না, যা শেষ পর্যন্ত আমাকে বলতে বাধ্য করলো – “আরে, আমরাও ইঞ্জিনিয়ারিং এর অংশ”।”
তার দলের এ্যাপোলো সফটওয়্যার সিস্টেম এতটাই উন্নত ছিলো যা পরবর্তীতে প্রথম আমেরিকান স্পেস স্টেশন (Skylab) এবং স্পেস শাটলেও ব্যবহৃত হয়েছিলো।
হ্যামিল্টন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার থেকে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, আমেরিকান সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
ক্যাথরিন জনসন :
তিনি ছিলেন একজন গণিতবিদ যিনি মহাকাশযানের গতিবিধি হিসেব করে এ্যাপোলো–১১ এর মহাকাশচারীরা কি করে চাঁদের কাছে পৌছাবে তা বের করেছিলেন।
বর্তমানে ১০০ বছর বয়সী জনসনকে Hidden Figures নামক মুভিতে চিত্রিত করা হয়েছে। ক্যাথরিন হিসেব করে বের করেছিলেন কিভাবে মূল স্পেসশিপ (কলাম্বিয়া) থেকে লুনার মডিউল (ঈগল) চাঁদে অবতরণ করবে এবং কোনো কারনে এই সিস্টেম সফল না হলে মহাকাশচারীদের জন্য ব্যাক আপ নেভিগেশন চার্টের পরিকল্পনা ও তিনি করেছিলেন।
এ্যাপোলো–১১ এর হিসেব নিকেশের পাশাপাশি তিনি অ্যালান শেফার্ডের ১৯৬১ সালের বুধ মিশনের জন্য মহাকাশযানের গতিবিধি বিশ্লেষণ পরিচালনা করেছিলেন। ব্যাক আপ প্যারামিটারগুলোতে তার গবেষনা পৃথিবীতে এ্যাপোলো–১৩ কে নিরাপদ অবতরণে সাহায্য করেছিলো।
শিলা থিবোল্ট :
শিলা থিবোল্ট (Sheila Thibeault) এ্যাপোলোর রেন্ডেভাস (Rendevzous) ডকিং সিমুলেটর (একটি জটিল যন্ত্র যা মহাকাশচারীদের লুনার ল্যান্ডারকে পুনরায় মূল মহাকাশযানে সংযুক্ত করার অনুশীলনে ব্যবহৃত হয়েছিলো)– এ কাজ করেছিলেন।
থিবোল্ট পরবর্তীতে এম আই টি টেকনোলোজি রিভিউ–কে বলেছিলেন, ” এটাকে অনেক বড় ঝুঁকি হিসেবে ধরা হয়েছিলো। কারন, যদি কোনো কারনে লুনার মডিউলকে আগের জায়গায় সংযুক্ত করা বা ডকিং এ কোনো সমস্যা হয়, তবে আমরা আমাদের দুইজন মহাকাশচারীকে হারাতে পারতাম এবং তখন আমাদের কিছুই করার থাকত না”।
এই প্রজেক্টের সফলতা তার নাসাতে একটি লম্বা ও সফল ক্যারিয়ারের সূচনা করেছিলো। থিবোল্ট বর্তমানে মহাকাশচারীদেরকে মহাকাশের রেডিয়েশন থেকে রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক পোশাকের ডিজাইন করছেন।
ক্রিস্টিন ডারডেন :
ক্রিস্টিন ডারডেন (Christine Darden) ছিলেন এ্যাপোলোর যুগের অনেকগুলো মানব কম্পিউটারের একজন। তার নাসা বায়োগ্রাফি থেকে জানা যায়, তার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তার সুপারভাইজার তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনে বদলী করেন, যেখানে তিনি খুব কম সংখ্যক নারী এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারদের একজন ছিলেন।
ডারডেনকে ও Hidden Figures এ তুলে ধরা হয়েছে, যিনি নাসাতে প্রায় চার দশক ধরে কাজ করেছেন এবং সাথে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডক্টরেট সম্পন্ন করেছেন।
তিনি বর্তমানে শব্দ বোমা (Sonic boom) এর শীর্ষস্থানীয় একজন বিশেষজ্ঞ। পাশাপাশি তিনি সুপারসনিক প্রবাহে “হাই লিফট উইং ডিজাইন “, “ফ্ল্যাপ ডিজাইন “, “সনিক বুম প্রেডিকশন” ও “সনিক বুম মিনিমাইজেশন” এর উপরে প্রায় ৫০ টি প্রকাশনার লেখিকা।
জোয়ান মরগান :
এ্যাপোলো–১১ এর ইন্সট্রুমেন্টেশন কন্ট্রোলার জোয়ান মরগান (JoAnn Morgan) ছিলেন স্যাটার্ন–ভি রকেট উড্ডয়নের সময় ফায়ারিং রুমের একমাত্র নারী।
মরগান নাসা–তে প্রায় ৪৫ বছরের কর্মজীবন অতিক্রম করেছেন এবং অনেক কাজেই প্রথম নারী ছিলেন, যেমন : ডিভিশন প্রধান, কেনেডি স্পেস সেন্টারের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, সহযোগী পরিচালক এবং মিশনের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বিভাগের পরিচালক।
জুডি সুলিভান :
জুডি সুলিভান এ্যাপোলো–১১ মিশনের বায়োমেডিক্যাল সিস্টেমের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
তিনি মহাকাশচারীদের হৃদস্পন্দন, রক্ত চাপ, শ্বাস প্রশ্বাস, দেহের তাপমাত্রা এর উপর লক্ষ্য রাখতেন। জুডি সুলিভান (judy Sullivan) ১৯৬৬ সালে নাসা এর মহাকাশযান অপারেশন গুলোতে প্রথম নারী প্রকৌশলী ছিলেন।
পেরিশ নেলসন হিরাসাকি:
(Parrish Nelson Hirasaki) :তিনি মহাকাশচারীরা যেন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সময় পুড়ে না যায় তার জন্য তাদের হিট শীল্ডের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হিসাব করেছিলেন।
হিরাসাকি ডিউক কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর নাসায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এ্যাপোলো–১১ এর জন্য হিরাসাকি হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রার হিট শীল্ড হিসেব করেন যেন মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে অক্ষত ফিরে আসতে পারেন।
ফ্রান্সিস পপি অর্থকাট :
(Frances Poppy Northcutt) : তিনি ছিলেন নাসার মিশন কন্ট্রোলে প্রথম নারী। তিনি এ্যাপোলো মিশনে অংশগ্রহণকারী মহাকাশচারীদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার ক্যালকুলেশন করেছিলেন।
নাসায় কাজ শেষ করার পর তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং একজন এটর্নি হয়ে নাগরিক অধিকার ও নারীদের অধিকারের উপরে ফোকাস করেন।
নাসা–তে কাজ করা সহকারী বা সচিব :
এ্যাপোলো মিশনের সফলাতার সাথে তাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিলো কারন তারা সকল জটিল রিপোর্ট, ম্যানুয়াল, চেকলিস্ট গুলো টাইপ করেছিলেন।
জ্যামি ফ্লাওয়ারসের (Jamye Flowers) মতো অনেক সহকারী/সচিবই নাসায় কাজ করতেন। তিনি নাসায় হাই স্কুল শেষ করেই যুক্ত হয়েছিলেন এবং শেষ করেছিলেন নাসার বিভজন্ন গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ নোট–ফাইল তৈরির মাধ্যমে। এ্যাপোলো–১০ এর মিশন কমান্ডার টম স্ট্যাফোর্ড মিশনের মাসকট “স্নুপি” এর নাক স্পর্শ করছেন, যা ধরে রেখেছেন জ্যামি ফ্লাওয়ারস, যিনি মহাকাশচারী গর্ডন কুপারের সেক্রেটারি।
এবং অবশ্যই,
এ্যাপোলো–১১ মিশনে যাওয়া তিনজন মহাকাশচারীর স্ত্রী :
জেনেট আর্মস্ট্রং, জোয়ান অলড্রিন, প্যাট কলিন্স। (Janet Armstrong, Joan Aldrin, and Pat Collins)
এ্যপোলো–১১ এর কর্মীরা তাদের ২১ দিন ট্রেনিং এর সময় স্ত্রীদের সাথে দেখা করছেন |
বাজ অলড্রিনের ১১ বছর বয়সী ছেলে, অ্যান্ডি, তার বাবার চাঁদে অবতরণ সম্পর্কে ১৯৬৯ সালের জুলাইতে বলেছিলো, ” এটা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিলো!” কিন্তু মিসেস অলড্রিন বলেন, ” আমি চাইনা অ্যান্ডি তার বাবার পথ অনুসরন করুক। আমি এই অবস্থার মধ্য দিয়ে দুইবার যেতে পারব না!”