“চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও। চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও,” সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া এই গানটি যেকোন মানুষকে আবার সেই পুরোনো যুগে ফিরে নিয়ে যেতে চায়। মনে হয় যদি আবারো যত্ন করে প্রিয় মানুষদের কাছে চিঠি পাঠানো যেত। বর্তমানের ডিজিটাল যুগে হুটহাট পাঠানো বার্তা আর পুরোনো যুগের চিঠির মাঝে রয়েছে বিরাট ব্যবধান, চিঠির মাঝে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা, মায়া, বেদনা বা অন্যান্য অনুভূতিগুলো আজকালকার ইমোজি দিয়েও বুঝানো সম্ভব নয়। তবুও আমাদের দেশের মানুষের মাঝে আজও যে চিঠি লেখার প্রবল ইচ্ছে লুকিয়ে আছে, তা প্রকাশ পেয়েছে সাজিদ হাসানের তৈরি Chithi.me অ্যাপের মাধ্যমে।
এই অ্যাপই যেন পুরোনো চিঠি পাঠানোর সংস্কৃতিকে নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে। সাজিদ হাসানের হাত ধরেই আজ দেশের হাজারো মানুষ পুনরায় তাদের প্রিয় মানুষদের কাছে খুবই যত্নসহকারে চিঠি পাঠাতে শুরু করেছে। ঠিক কীভাবে তিনি Chithi.me অ্যাপের আইডিয়া খুঁজে পেলেন, কেমন ছিল তার যাত্রা তাই জানার চেষ্টা করবো আজকের এই ইন্টারভিউ ব্লগের মাধ্যমে।
প্রথমেই আপনার পরিচয় দিয়ে শুরু করতে চাই। আপনার নাম, পড়াশোনা, বেড়ে উঠা এবং বর্তমানে কী করছেন।
আমি সাজিদ হাসান। বর্তমানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়ন করছি। আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে ময়মনসিংহে। আমি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছি। বর্তমানে আমার সময় কাটে মূলত পড়াশোনাতেই। কিন্তু পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি টুকিটাকি প্রোগ্রামিং/ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টস এ কাজ করে থাকি। কয়েকটা সংস্থা, আর আমার কয়েকটা নিজের স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করছি ধীরে ধীরে।
ম্যাসেঞ্জার, হোয়াইটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামের এই যুগে মানুষ প্রায়ই বার্তা আদান-প্রদান করে থাকে। তা সত্ত্বেও চিঠি নিয়ে অ্যাপ বানানোর আইডিয়া কীভাবে আসলো? যদি এর পিছনের গল্পটা আমাদের সাথে শেয়ার করতেন।
আমি যখন খুব ছোটো, আমার বড় ভাইয়া ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। তখন যতটুকু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিলো তা ব্যবহার করেই ভাইয়াকে প্রায় সময়ই চিঠি লিখতাম। সেই থেকেই চিঠির সাথে আমার একটা আত্মিক সংযোগ থেকে যায়।
ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামের ক্ষুদে বার্তায়ই আমাদের অধিকাংশ আলাপন সীমাবদ্ধ থাকে আজকাল। আমরা কিছু না ভেবে, না চিন্তা করে মাথায় যা আসে তাই পাঠিয়ে দিই বন্ধুদের। আগের দিনে যেরকম অনেক ভেবেচিন্তে একটা চিঠি লিখা হতো, সেই ব্যাপারটা এখন আর নেই। একটা চিঠিতে যতটুকু যত্ন বা ভালোবাসা নিহিত থাকে, সেটা আমাদের বর্তমান যান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় কল্পনা করা যায় না। এই ব্যাপারটিকে মিস করি, সেই থেকেই চিঠির আইডিয়াটা মাথায় আসে।
আপনার একাডেমিক লাইফ ও অন্যান্য সব কাজের সাথে তাল মিলিয়ে এই অ্যাপ এর আইডিয়া জেনারেশন থেকে নিয়ে ডেভেলপ করা পর্যন্ত পুরোটা সময় কীভাবে ম্যানেজ করেছেন?
আমার সবসময় নতুন নতুন প্রোজেক্টে কাজ করতে ভালো লাগে। চিঠি অ্যাপটি নিয়ে আগেই ভেবেছিলাম, কিন্তু কাজ শুরু করি আমার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার মধ্যে। পড়াশোনায় একঘেয়েমি ধরে গিয়েছিলো, ইচ্ছা করছিলো পড়ার ফাঁকে কিছু করি। আর তখনই কাজ শুরু করে দিই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের প্রতিটি পরীক্ষা হয় এক সপ্তাহ অন্তর। কাজেই একটা পরীক্ষার পর ছয়দিন সময় পাওয়া যায়। সেই ছয়দিনের প্রথম এক-দুই দিন করে কাজ করতে করতে শেষ পরীক্ষার ঠিক আগে অ্যাপটি মোটামুটি দাঁড় হয়ে যায়।
অ্যাপ ডেভেলপ এর সময় কখনো কী হাল ছেড়ে দেয়ার মতো অনুভূতি কাজ করেছিল?
অ্যাপ ডেভেলপ এর সময় কখনো হাল ছেড়ে দেওয়ার মতন অনুভূতি কাজ করেনি আমার। কারণ আমি কখনোই অ্যাপটি সবাই ব্যবহার করবে এমন ভেবে তৈরি করেনি। আমি অ্যাপটি বানিয়েছিলাম শুধুমাত্র আমার সৃজনশীলতা অনুশীলন করতে আর পড়াশোনা থেকে ছোটো ছোটো ব্রেক নিতে।
Chithi.me অ্যাপ ঠিক কবে নাগাদ প্রকাশ করা হয় এবং বর্তমান পর্যন্ত কতজন গ্রাহক এই অ্যাপটি ব্যবহার করেছেন?
Chithi.me অ্যাপটা পাবলিশ হয় নভেম্বারের ৯ তারিখে (২০২৪ সালে)। বর্তমানে অ্যাপের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।
আপনার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে মজার বা অদ্ভুত ধরনের চিঠির ঘটনা যদি আমাদের সাথে শেয়ার করতেন।
কলেজে পড়ার সময় আমার ব্যাগে একটি প্রেমপত্র পেয়েছিলাম। এটি কে দিয়েছিলো এখনো জানি না।
অ্যাপটির ফন্ট এবং চেহারায় এক ধরনের নস্টালজিয়া ভাব আছে। এই রকম সুন্দর একটা ডিজাইনের আইডিয়া কীভাবে আসলো?
আমার ভাইয়াকে ছোটোবেলায় যে চিঠিগুলো দিতাম, সেগুলো ভাইয়া ছবি তুলে একবার আমাদের দেখিয়েছিলো। সেই থেকেই মনে হলো অ্যাপটিতে এরকম ডিজাইন দিতে চাই।
আপনি অ্যাপটির ডিজাইনের মাধ্যমে চিঠির যে ঐতিহ্য তা ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন যা প্রশংসনীয়। এই কাজটি করতে গিয়ে আপনি কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন?
অ্যাপ তৈরির সময় উল্লেখযোগ্য কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইনি আসলে। অ্যাপের কনসেপ্ট যেরকম সহজ, ডেভেলপমেন্টের পার্টটাও খুব একটা জটিল ছিলো না। তবে এর কারণ হতে পারে আমার অনেকদিনের অভিজ্ঞতা।
অ্যাপটিতে বেনামী চিঠি লেখার অপশন রয়েছে। এই অপশনটি মানুষের অনুভূতি প্রকাশে সহায়ক বলে মনে করেন? এতে নেতিবাচক কোনো প্রভাব আসতে পারে বলে মনে করেছিলেন কী?
এটার ভালো দিক, মন্দ দিক উভয়েই আছে। অনেক কথা থাকে যা আমরা সরাসরি বলতে সংকোচ বোধ করি, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাছাড়া চিঠি বেনামী হওয়ার ফলে গ্রাহকের কাছেও ব্যাপারটা অনেক ইন্টারেস্টিং হয়েছে। আর আপনি যদি ভেবে দেখেন, সত্যিকারের চিঠিও বেনামী হওয়া সম্ভব, কেননা আমি প্রেরকের স্থানে যা খুশি তাই লিখতে পারবেন। চিঠি অ্যাপেও সেরকম ভাবে চাইলে নাম দিয়েও চিঠি দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু এই বেনামী পদ্ধতিকে অপব্যবহার করা খুব সহজ। একারণে আমি বর্তমানে একটি “ব্লকিং” ফীচারের উপর কাজ করছি।
Chithi.me অ্যাপটির ব্যবহার বর্তমানে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এত বেশি ব্যবহারকারী এবং সার্ভার চাপ সামলাতে কী কোনো বড় সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
হ্যাঁ! সার্ভারের চাপ মোকাবেলা করাটা আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। যখন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করলো, তখন অ্যাপের গতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এই পরিস্থিতিতে, আমি একই সাথে দুটি দিকে মনোযোগ দেই; প্রথমত, সার্ভারের অবকাঠামো উন্নত করি, এবং দ্বিতীয়ত, আমার লেখা কোড আরও কম রিসোর্স ব্যবহার করে যেন কাজ করে সেই লক্ষ্যে অপটিমাইজ করি। অ্যাপটি কোনো প্রকার বিরতি ছাড়াই চালু রেখে এই পরিবর্তনগুলো আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু এখন, একটি উন্নত ও আধুনিক সিস্টেমে স্থানান্তরের মাধ্যমে, পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি ব্যবহারকারীকে সুষ্ঠুভাবে সেবা দিতে পারছি।
Chithi.me এর মতোই কিছুটা NGL নামে একটি অ্যাপ আছে। তবুও আমাদের দেশে বর্তমানে Chithi.me অ্যাপটির জনপ্রিয়তার পিছনে কোন কারণটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
আমি মনে করি চিঠি আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ। এর জন্যই Chithi.me অ্যাপটি এত বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অ্যাপটি সবার সাথে মানসিকভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে।
ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে এমন কোনো প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন যা আপনাকে অবাক করেছে বা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে?
ব্যবহারকারীদের থেকে অনেক সুন্দর সুন্দর বার্তা পেয়েছি। অনেকের গল্প শুনেছি। তাঁরা তাদের প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন থেকে কিভাবে কত কি চিঠি পেয়েছেন সেই গল্প শুনেছি। তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
Chithi.me অ্যাপটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কী?
Chithi.me অ্যাপটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে! খুব শীঘ্রই কাজে হাত দিবো।
এই অ্যাপটি ছাড়াও আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা বা আপনার লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাই।
আমার নিজের আরো বেশ অনেকগুলো প্রোজেক্ট, স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু আমার মূল লক্ষ্য হলো উচ্চশিক্ষা অর্জন করা, পদার্থবিজ্ঞান বা প্রকৌশলবিদ্যায় আমার কোনো অবদান রেখে যাওয়া।
ধরুন, বিজ্ঞানের কাল্পনিক জগতে আপনি চাইলেই যেকোন সময়ের একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে চিঠি লিখতে পারবেন। তাহলে আপনি কাকে চিঠি লিখে পাঠাতেন এবং কেন?
খুব ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। আমি আসলে অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিকেই চিঠি লিখতে চাই।
যেমন, এই মুহূর্তে আমার মন চাইছে প্রখ্যাত গণিতবিদ পিয়ের দ্য ফার্মা-কে একটি পত্র লিখি এবং তাঁর শেষ উপপাদ্যের সেই অধরা, সহজ প্রমাণটি আমাদের কাছে প্রকাশ করার অনুরোধ করি।
আপনার মতোই যে সকল তরুণ, তরুণী চমৎকার কিছু অ্যাপ বানিয়ে দেশের মানুষের মাঝে ভিন্ন ধরনের ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন।
দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাওয়াটা সত্যি প্রশংসনীয় একটি ব্যাপার। কিন্তু আমার মনে হয় কোনো একটা অ্যাপ তৈরি বা প্রোগ্রামিংয়ের কাজটা শুধু দেশের জন্য কিছু করবো এই ভাবনা থেকে না করে, নিজের ভালো লাগা এবং উপভোগের জায়গা থেকেও করা উচিত।
সর্বশেষে, যদি “Chithi.me” অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্যে এক বাক্যে কিছু বলতেন!
আমি সবার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ যে আমার অ্যাপটি এতটা সমাদৃত হয়েছে। সবাইকে ধন্যবাদ অ্যাপটি ব্যবহার করার জন্য।
দিদারুল ইসলাম / সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী