এলিয়েনসহ মহাজাগতিক সকল আক্রমণ থেকে আমেরিকাকে যেমন রক্ষা করার দায়িত্ব নেয় ফিকশনাল ক্যারেক্টার নিয়ে গঠিত দল অ্যাভেঞ্জার্স (Avengers), তেমনি পৃথিবীর বেলায় সেই দায়িত্ব পালন করে ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও আয়নোস্ফিয়ার। কসমিক রে (মহাজাগতিক রশ্মি),রেডিয়েশন সহ সৌরঝড় সকল কিছু থেকে পৃথিবীকে সুরক্ষা কবজের মতো এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড রক্ষা করছে। তবে ঘটনা যদি এমন হয় যে এই সুরক্ষা কবজের গোলযোগই পৃথিবীর জীবজগতের জন্য ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ তাহলে তা ম্যাগনেটিক ফিল্ড কে বিদ্রুপ করার মতোই হবে। ঠিক এমনি এক ঘটনার আবিষ্কার করেছেন University of Rochester এর গবেষকরা।
নতুন প্রকাশিত এক গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৫৯০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডে গোলযোগ সৃষ্টি হয় যার স্থায়িত্ব ছিল ৫৯১ মিলিয়ন থেকে ৫৬৫ মিলিয়ন খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, প্রায় ২৬ মিলিয়ন বছর! এই পুরো সময় পৃথিবীর সুরক্ষা ব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে যায় আর অরক্ষিত পৃথিবীর এমন আকর্ষিক পরিবর্তন নিয়ে আসে যে তা পৃথিবীর প্রথম বহুকোষী যৌগিক (Multicellular Complex) জীবের পৃথিবীতে বিচরণের সূচনা করে। এছাড়াও বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং তা বহুকোষী জীবের অভিযোজনের আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে।
গবেষণায় আরো উঠে আসে, এই সময়ে Ediacaran Fauna বা Ediacaran Biota (এডিয়াকারান বায়োটা) শ্রেণীর জটিল জীবের আবির্ভাব ঘটে। এডিয়াকারান বায়োটা হলো প্রাণিজগতের একটি বিশেষ শ্রেণি যেখানে পৃথিবীর এডিয়াকারন সময়কালের (Ediacaran Period) পৃথিবীতে উপস্থিত সকল প্রাণ অন্তর্ভুক্ত। এডিয়াকারান সময়কাল ৬০০ মিলিয়ন থেকে প্রায় ৫৩৮ মিলিয়ন বছরের মধ্যকার সময়কে বলে। এই শ্রেণীর প্রাণীগুলো ছিল রহস্যময় টিউবুলার (নালীকাকার), ফান্ড আকৃতির, অধিকাংশ অস্থির (বিচরণশীল) জীব। এরা তুলনামূলক ভাবে নরম দৈহিক গঠন বিশিষ্ট ছিল বলে দাবি করা হয় এবং ধারণা করা হয় এদের সাথে বর্তমান জেলিফিশ, কেঁচো জাতীয় পোকামাকড়, সামুদ্রিক স্পঞ্জি সহ সকল তুলতুলে নরম জাতীয় প্রাণীর সম্পর্ক রয়েছে!
এডিয়াকান শ্রেণীর প্রাণী সমগ্র পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম জটিল বহুকোষী জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৯৫ সালে প্রথম মেক্সিকোতে এডিয়াকার পিরিয়ডের জীবাশ্মের সন্ধান মেলে যা আজ থেকে প্রায় ৫৫৫ মিলিয়ন বছর পুরোনো ছিল!
পৃথিবীর আয়নোস্ফিয়ার ও ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সংকোচন অথবা ঘনত্ব হ্রাসের ঘটনা পৃথিবীর জন্য নতুন কিছু নয়। খুব ছোট্ট পরিসরে বিক্ষিপ্ত ভাবে এসব হরহামেশাই ঘটে এবং কয়েক হাজার বছর থেকে কয়েকশ হাজার বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে৷ এই সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ রেডিয়েশন, সৌর ঝড়ে সম্মুখীন হয়। এতে করে পরিবেশে কেমন প্রভাব পড়ে তা নিয়ে গবেষণা চালানো হচ্ছে বহু যুগ ধরেই। আর গবেষকদের সূক্ষ্ম ধারণা ছিল যে দুর্বল সুরক্ষা ব্যবস্থায় অরক্ষিত পৃথিবীতে রেডিয়েশনের কারণে আদিতে পৃথিবীর জীবজগতে তার প্রভাব থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু এই ধারণা কিছু গবেষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বাকিদের ভাষ্য মতে, এসব সৌর ঝড় বা রশ্মির বর্ষণ খুব একটা ক্ষতির কারণ হতে পারে না কারণ বায়ুমণ্ডল খুব সহজেই তা প্রতিহত করতে পারে।
তবে এডিয়াকার পিরিয়ডের নরম অঙ্গাণু (Soft Body) বিশিষ্ট প্রাণীদের বেলায় প্রভাব স্পষ্টত লক্ষণীয়। কারণ পূর্ববর্তী একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত যে, প্রাণী বৈচিত্রের জন্য দায়ী বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রের পানিতে আকর্ষিক অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। যদিও এটি এখনো সুস্পষ্ট না ঠিক কীভাবে এই মাত্রা বৃদ্ধি পায়! এই ধাঁধার সমাধান করতে গবেষণা দলের সদস্য John Tarduno ও তার সহযোগীরা পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করেন।
তাদের প্রথম গবেষণা বস্তু ছিল Earth Crust বা পৃথিবীর ভূত্বক যার স্তরে স্তরে মিশে আছে পৃথিবীর ইতিহাস। ব্রাজিলের ৫৯১ বছর পুরোনো সূর্যের নমুনা নিয়ে গবেষণা করে মাটিতে এক ধরনের আণুবীক্ষণীক চৌম্বকীয় মিনারেলের সন্ধান পায় যা থেকে সেই সময়ে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তিমাত্রার ধারণা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল মতে সে সময় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তিমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে কম ছিল, ধারণা করা হয় বর্তমান সময় থেকে ৩০ গুণ কম।
অতঃপর পুনরায় একাধিক সময়ের ভূতাত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করে মোট ২০০০ মিলিয়ন বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায় প্রায় ২৬ বছর, ৫৯১ থেকে ৫৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্ব পর্যন্ত এমন খর্বশক্তির চৌম্বক ক্ষেত্র বিরাজমান ছিল।
আর এই প্রাপ্ত ডাটার সাথে হঠাৎ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রে অক্সিজেনের মাত্রার বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা মিলিয়ে দেখলে দুটো ঘটনা প্রায় কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। অক্সিজেন বৃদ্ধির ঘটনা ৬৭৫ থেকে ৫৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বের সময়কার যা ঠিক ২৬ মিলিয়ন বছরের পিরিয়ডের মাঝেই।
ফলশ্রুতিতে গবেষণা দল দাবি করে উক্ত চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তিমাত্রার খর্বতা জনিত কারণেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রভাব পড়ে আর অক্সিজেন মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এতে এককোষী জীবের পাশাপাশি বহুকোষী যৌগিক জীবের অভিযোজনের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয় এবং সূচনা ঘটে নতুন এক জীববৈচিত্র্যের অধ্যায়।
এস এম ইফতেখার আলম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ- ইন্ট্রেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, কসমস ম্যাগাজিন , সাইন্স এলার্ট