আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এর অন্যতম ভিত্তি কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স অত্যন্ত রহস্যজনক ও চমকপ্রদ বটে। গত এক শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রাথমিক ধারণা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এবার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বহুল আলোচিত তত্ত্ব কণিকার কণা-তরঙ্গ দ্বৈত নীতি নিয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন একদল গবেষক। প্রথমবারের মতো মৌলের পরমাণু একই সাথে কণা ও তরঙ্গরূপে আচরণ করার ছবি ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
ছবিতে দেখা যায় লাল রঙের পরমাণু কণা অস্পষ্ট কম্পনশীল তরঙ্গে রূপান্তরিত হচ্ছে। পরমাণুর দুই রূপের সহ অবস্থান কেন্দ্রিক তোলা এটিই প্রথম পরিষ্কার ছবি যা শতাব্দী পুরোনো তত্ত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করলো। নিউটনীয় বলবিদ্যা বা ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের একছত্র আধিপত্যের পর বিংশ শতাব্দীতে ম্যাক্স প্লাংক, আইন্সটাইনসহ অনেকের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান(Modern Physics)।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মূল দুই ভিত্তি: জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি ও কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স। এর মধ্যে তুলনামূলকভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তিপ্রস্তর কিছুটা জটিল। কোয়ান্টাম পর্যায়ে বস্তু কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্ম বিরাজ থাকার এই ধারণা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তিপ্রস্তরের একটি। আলোক তরঙ্গ ধর্মের পাশাপাশি কণা ধর্মের আবিষ্কার হওয়ার ঠিক পরপরই পরমাণুর দ্বৈত-ধর্মের ধারণা জন্মায়।
পরমাণু সংশ্লিষ্ট একাধিক পরীক্ষামূলক গবেষণা চালানোর মাধ্যমে ততদিনে রবার্ট মিলিকান, জে জে থমসন এর মতো বিজ্ঞানীরা পরমাণুর কণা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।অতঃপর ১৯২৪ সালে লুই ডি ব্রগলী তার পিএইচডি থিসিসে ইলেকট্রন তরঙ্গ তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা দেন।
তিনি বলেন,
“নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণয়মান ইলেকট্রনকে তরঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কণা মূলত তরঙ্গ বান্ডিল যা একত্রিত হয়ে একটি কার্যকর ভর তৈরি করে।”
তার ঠিক দু বছর পর ১৯২৬ সালে স্রোডিঞ্জার, যিনি তার বিড়াল নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত, তিনি একটি সমীকরণ তৈরি করেন এবং নাম দেন ইলেকট্রনের গতির তরঙ্গ সমীকরণ, যা বর্তমানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নতুন অধ্যায় ওয়েব মেকানিক্স এর আলোচ্য বিষয়। তাদের উভয়ের ধারণা মতে কোয়ান্টাম পর্যায়ে বা কণিকা স্তরে সকল বস্তুর একই সাথে একই সময়ে কণা এবং তরঙ্গ ধর্ম বিদ্যমান।
তবে উভয় ধর্ম একই সাথে বিরাজ করলেও পরীক্ষাগারে অবজারভেশনের সময় শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধর্ম(কণা দশা) লক্ষ্য করা যায়। তরঙ্গ অবস্থায় বিরাজকালে এরা শক্তির তরঙ্গ প্যাকেট রূপে থাকে কিন্তু অবস্থান নির্দিষ্ট নয় বলে একটি নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে (ইলেক্ট্রনের বেলায় যাকে অরবিটাল বলে) সম্ভাবনার মাধ্যমে এদের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়।
ইতিমধ্যে অনেক পরীক্ষায় কণিকার দ্বৈতনীতি পর্যবেক্ষণ করা গেছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট ইলেকট্রনের দ্বৈত নীতির সবচেয়ে আদর্শ উদাহরণ সাব স্লিট এক্সপেরিমেন্টে পর্যবেক্ষণ ছাড়া ইলেকট্রন নিক্ষেপের ফলাফল তরঙ্গ দশাকে নির্দেশ করে কিন্তু যখনি পর্যবেক্ষণ করা হয় তখন আবার কণা দশার ফলাফল প্রদর্শন করে। চিরায়ত অর্থে পরমাণুতে দ্বৈত ধর্ম বিদ্যমান থাকলেও তরঙ্গ ও কণা উভয় ধর্মের ভৌত সিস্টেমের জন্য দুটি ভিন্ন মডেল রয়েছে যার প্রত্যেকটির প্রায়োগিক দিকেও রয়েছে বৃহৎ পরিসরে ভিন্নতা! তবে একটি অন্যটিতে হস্তক্ষেপ করে না।
উদাহরণস্বরূপ: তরঙ্গ তত্ত্ব তরঙ্গ সমীকরণ মেনে চলে এবং তরঙ্গের সকল আচরণ মেনে চলে। আবার সময়ের সাথে সাথে বিচ্ছুরণের কারণে এর স্থানিক ব্যাপ্তিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যেন সময়ের সাথে সাথে তরঙ্গের পরিসীমার পরিবর্তন হচ্ছে। অপরদিকে কণা ধর্ম বলবিদ্যার নিয়ম মেনে চলে। এর ভর আছে এবং এর ব্যাপ্তি বা পরিসীমার কেন্দ্র রয়েছে। মহাবিশ্বে বিরাজমান গ্রহ উপগ্রহ অথবা হাতে থাকা টেনিস বলের উপর প্রয়োগযোগ্য বলবিদ্যা ক্ষুদ্র পরিসরের এই কণাতে খাটে।
তবে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, কোয়ান্টাম পর্যায়ে এসব পরীক্ষায় পরমাণুগুলো কখনো তরঙ্গের মতো বিচ্ছুরণ দেখায়, কখনো আবার কণার মতো সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কণিকার এমন দ্বৈত আচরণ ক্যামেরা বন্দী করতে গবেষকরা প্রথমে লিথিয়াম পরমাণুকে শূন্য তাপমাত্রায় (-২৭৩° সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে শূন্য তাপমাত্রা বলে) ঠান্ডা করে লেজার বীমের মাধ্যমে আলোক ফোটন (আলোক কণিকা) দ্বারা আঘাত করানো হয়।
ফোটনের আঘাতে পরমাণুগুলোর ভরবেগের পরিবর্তন ঘটে। অতঃপর পরমাণুগুলো ঠান্ডা করা হলে এদের আবার লেজার বীমের অপটিক্যাল লেটিসে (আলোক জালিকায়) আলাদা বিচ্ছিন্ন প্যাকেট রূপে বন্দী করা হয়। অপটিক্যাল লেটিস বা আলোক জালিকা হলো পর্যায়ক্রমিক লেজার বিম দ্বারা তৈরি একটি আলোক জালিকার মতো কাঠামো যাতে ঠান্ডা পরমাণু আটকা পড়ে।
আলোক জালিকায় আটকা পড়া ঠান্ডা ও সুস্থিত আয়তনের পরমাণুগুলোকে পর্যায়ক্রমিকভাবে লেজার বীমের মাধ্যমে অপটিক্যাল লেটিস বা জাল চালু ও বন্ধ করে, কণা দশা থেকে জালিকার মতো দেখতে দশায় নিয়ে আবার পুনরায় কণা দশায় ফেরত নিয়ে আসা হয়। চলমান ঘটনার মাঝে একটি মাইক্রোস্কোপিক ক্যামেরা পরমাণুর দুইটি অবস্থানেরই আলাদা আলাদা সময়ে ছবি ফ্রেমবন্দি করে। এভাবে একাধিক ছবি তুলে তা একসাথে করার পর একটি সমাপনী ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হন তারা।
এ ব্যাপারে গবেষণাপত্রের সহকারী লেখক Tarik Yefsah বলেন,
”ছবি তোলার এই প্রক্রিয়ায় আমাদের বিম দ্বারা তৈরি আলোক জালিকাকে পর্যায়ক্রমিক ভাবে বন্ধ করে চালু করার মাধ্যমে পরমাণুকে স্বল্প সময়ের জন্য তরঙ্গে রূপান্তর করা গেছে, কিন্তু তার পুনরায় আবার কণা দশায় রূপান্তরিত হওয়ায় তরঙ্গ দশা বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না।”
গবেষকদের মতে এটি দ্বৈত নীতির সবচেয়ে সরলতম উদাহরণ। তাদের পরবর্তী কাজ হবে কীভাবে এই প্রক্রিয়ার আরো জটিলতম পরমাণু মডেল নিয়ে সুস্পষ্ট গবেষণা করা যায়। এ ধরনের গবেষণা আমাদের কোয়ান্টাম পর্যায়ের অদ্ভুত আচরণ সম্পর্কে আরো প্রগাঢ় ধারণা দিবে। যেমন: নিউট্রন তারকার অভ্যন্তরীণ উচ্চ ঘনত্বের পদার্থ অথবা বিগব্যাং পরবর্তী কোয়ার্ক লেভেলের প্লাজমা নিয়ে আরো বিস্তার জানার সুযোগ হবে বলে মনে করেন তারা।
এস এম ইফতেখার আলম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: লাইভসায়েন্স, আইএফএলসায়েন্স, সাইয়েন্সেসস্প্রিংস