“যদি কেউ তোমাকে আঘাত করে তাহলে ভেঙ্গে পড়বে না, বরং নিজেকে আরও শক্ত ভাবে গড়ে তুলবে।”
এই নীতি কথাটিরই যেন বাস্তব রূপ দিয়েছে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, মার্সেড এর গবেষণা দল! তারা এমন এক নরম ও নমনীয় পদার্থ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যা আঘাত পেলে বা প্রসারিত হলে শক্ত হয়ে যায়, দেখতে অনেকটা স্প্যাগেটি এর মতো এবং উপাদানটি বিদ্যুৎ পরিবাহী। ফলে ভবিষ্যতে আমাদের ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও এই উপাদান দ্বারা তৈরি করা সম্ভব হবে যা যন্ত্রের নিরাপত্তা আরও কঠোরভাবে নিশ্চিত করবে।
কর্নস্টার্চ স্লারি থেকে অনুপ্রাণিত একটি মডেল:-
কর্নস্টার্চ স্লারি হলো কর্নস্টার্চ পানির মিশ্রণ যা সস, স্যুপ, স্ট্যু এবং গ্রেভি ঘন করতে ব্যবহৃত হয়। মূলত রান্নায় ব্যবহৃত এই উপাদান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এই মডেল তৈরি করা হয়।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার পদার্থ বিজ্ঞানী এবং প্রকল্পের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ইউ (জেসিকা) ওয়াং এক বিবৃতিতে বলেছেন,
“আমি যখন কর্নস্টার্চ এবং জল ধীরে ধীরে নাড়তে থাকি, তখন চামচটি সহজেই নাড়ানো যায়। কিন্তু আমি যদি চামচটি তুলে নিয়ে তারপর মিশ্রণটিতে চামচ দিয়ে সজোরে আঘাত করি, চামচটি ফিরে যায় না, বরং অনেকটা কোনো শক্ত পৃষ্ঠে আঘাত করার মতো হয়”।
ওয়াং ও তার দলের লক্ষ্য ছিল এই বৈশিষ্ট্য সহ একটি কঠিন পরিবাহী উপাদান তৈরি করা।
ধাতু, যা বিদ্যুৎ পরিবাহী সাধারণত শক্ত বা ভঙ্গুর হয়। কিন্তু গবেষকরা কনজুগেটেড (জোড়ায় থাকা) পলিমার ব্যবহার করে নরম এবং নমনীয় সংস্করণ তৈরি করার উপায় তৈরি করেছেন। যাতে এই উপাদান দিয়ে তৈরি কোন যন্ত্র সহজে ভেঙ্গে যেতে না পারে।
তবুও, বেশিরভাগ নমনীয় পলিমারগুলো যদি বারবার, দ্রুত, অধিক চাপের সম্মুখীন হয় তবে তা ভেঙে যায়। তাই, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, মার্সেড- এর ওয়াং-এর দল একটি টেকসই উপাদান তৈরি করতে কনজুগেটেড পলিমারগুলোর সঠিক সংমিশ্রণ বাছাই করেছে যা পানিতে কর্নস্টার্চ কণাগুলোর মতো “অভিযোজিত স্থায়িত্ব”(বাহ্যিক বলের বিরুদ্ধে সুরক্ষা এবং চাপের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে) আচরণকে অনুকরণ করবে।
প্রথমত, বিজ্ঞানীরা চারটি পলিমারের একটি জলীয় দ্রবণ তৈরি করেন: খাটো পলিঅ্যানিলিন অণু, লম্বা, স্প্যাগেটি-সদৃশ পলি (2-acrylamido-2-methylpropanesulfonic acid), এবং পলি (3,4-ethylenedioxythiophene) পলিস্টাইরিন সালফোনেট (PEDOT: PSS) নামে পরিচিত একটি উচ্চ পরিবাহী মিশ্রণ। এই নামগুলো অনেকের কাছেই বেশ জটিল মনে হবে।
তবে চিন্তার কিছু নেই- শুধু এটুকু জানলেই হবে যে এই সংমিশ্রণটি একটি ফিল্ম (কণার একটি পাতলা স্তর) তৈরি করে যাতে তাৎক্ষণিক আঘাত করলে এটি বিকৃত বা প্রসারিত হয় কিন্তু সহজে ভেঙ্গে যায় না। গবেষকরা পরে এই ফিল্ম এর গাঠনিক ও যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে দেখেন।
তারা দেখলেন যে খুব দ্রুত ও তাৎক্ষণিক আঘাতে বস্তুটি ভেঙ্গে না গিয়ে এটি বিকৃত বা প্রসারিত হয়েছে। যত দ্রুত প্রভাব ফেলবে, ফিল্মটি তত বেশি প্রসারিত এবং শক্ত হয়ে উঠবে। আশ্চর্যজনকভাবে, PEDOT:PSS- এর মাত্র ১০% সংযোজন উপাদানটির পরিবাহিতা এবং অভিযোজিত স্থায়িত্ব উভয়ই বৃদ্ধি করেছে। এই ফলাফলটি অপ্রত্যাশিত ছিলো কারণ PEDOT এবং PSS উচ্চ বা দ্রুত প্রভাবের ক্ষেত্রে আরও অস্থিতিস্থাপক হয়ে যায়।
চারটি পলিমার, দুটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত এবং দুটি ঋণাত্মক চার্জযুক্ত। এদেরকে একত্রে মিশ্রণ করলে অনেকটা একটি পিণ্ডের মতো মনে হয়। অনেকটা একটি বড় বাটিতে স্প্যাগেটি এবং মিটবল একত্রে মিশালে যেমনটা দেখায় ঠিক তেমন।
“কারণ ধনাত্মক চার্জযুক্ত অণুগুলো জল পছন্দ করে না, তারা মিটবলের মতো মাইক্রোস্ট্রাকচার গঠন করতে পারে,” ওয়াংয়ের ল্যাবের পোস্টডক্টরাল গবেষক ডি উ একটি বিবৃতিতে বলেছেন।
ব্যবহৃত উপকরণগুলোর মানোন্নয়ন:-
গবেষক ডি উ দেখতে চেয়েছিলেন কীভাবে ছোট অণু যোগ করলে এমন একটি যৌগিক উপাদান তৈরি করা যায় যা প্রসারিত করলে আরও শক্ত হয়। যেহেতু সকল পলিমারের চার্জ ছিলো, দলটি পরীক্ষা করার জন্য ধনাত্মক, ঋণাত্মক বা নিরপেক্ষ চার্জযুক্ত অণু বেছে নিয়েছে। তারপরে তারা মূল্যায়ন করেছে যে কীভাবে সংযোজনগুলো পলিমারের মিথস্ক্রিয়াকে সংশোধন করতে পারে এবং প্রতিটি উপাদানের অভিযোজিত স্থায়িত্বকে প্রভাবিত করে।
প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে ১,৩-প্রোপেনডিয়ামাইন দিয়ে তৈরি ধনাত্মক চার্জযুক্ত ন্যানো পার্টিকেলগুলো ছিলো সেরা সংযোজন, যা সবচেয়ে অভিযোজিত কার্যকারিতা দেখায়। ডি উ বলেছেন যে এই সংযোজন পলিমারগুলোর মিথস্ক্রিয়াকে দূর্বল করে “মিটবল” তৈরি করে, আঘাত করার সময় তাদের আলাদা করা এবং বিকৃত করা সহজ করে তোলে এবং শক্তভাবে আটকে থাকা “স্প্যাগেটি স্ট্রিং”কে শক্তিশালী করে।
“আমাদের উপাদানগুলোতে ধনাত্মক চার্জযুক্ত অণুগুলো পলিমারে যুক্ত করা হয় যা এটিকে উচ্চ প্রসারিত অবস্থায় আরও শক্তিশালী করে,” ডি উ বলেছেন।
ওয়াং ব্যাখ্যা করেছেন যে দলের লক্ষ্য এখন কীভাবে এই হালকা পরিবাহী উপাদান বাস্তব-বিশ্বের পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা যেতে পারে তা নিশ্চিত করা।
নরম পরিধেয় সামগ্রী, যেমন স্মার্টওয়াচের জন্য ইন্টিগ্রেটেড ব্যান্ড এবং ব্যাকসাইড সেন্সর, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্স যেমন গ্লুকোজ মনিটাইজার বা কার্ডিওভাসকুলার সেন্সর, ইত্যাদিতে এই উপাদান ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে এগুলো আরও টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি হয়।
একটি নতুন কিছু আবিষ্কার অবশ্যই মানব জীবনের জন্য মঙ্গলজনক। তবে আমাদের এটিও দেখতে হবে নতুন কিছু আবিষ্কারের পর সেটি কতটা পরিবেশবান্ধব বা এদের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা। সেদিক থেকে দেখলে নতুন এই উপাদানটি সবেমাত্র এর প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ গবেষণাটি সফল হলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এটিকে ব্যবহার করতে পারবো। তখন বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির বাইরের আবরণ হিসেবে এই উপাদানটি ব্যবহার করা যাবে, ফলে সেগুলো আগের চেয়ে আরও অনেক টেকসই হবে।
“এখানে অনেক সম্ভাবনাই রয়েছে এবং আমরা খুবই আগ্রহী এই নতুন উপাদানটি আমাদের কোথায় নিয়ে যায় তা জানার জন্য”, বিজ্ঞানী ইউ ওয়াং বলেছেন।
আমিনুল ইসলাম সিয়াম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: সায়েন্স এলার্ট, এসিএস.অর্গ