সিমেন্ট এক ধরনের বন্ধন সৃষ্টিকারী উপাদান। এই পদার্থ নির্মাণ কাজের উপকরণগুলোকে একে অপরের সাথে মজবুতভাবে আবদ্ধ রাখে এবং দৃঢ়ভাবে কোনো স্থানে স্থাপিত করতে সহায়তা করে। সিমেন্ট হাইড্রোলিক ও নন-হাইড্রোলিক এই দুই ধরনের হতে পারে। নন-হাইড্রোলিক সিমেন্টের কোনো স্থানে স্থাপনের জন্য পানির প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে হাইড্রোলিক সিমেন্ট শুষ্ক পদার্থ ও পানির মাঝে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করতে সক্ষম হয়। তবে এসব উৎপাদনের সময় পরিবেশের ওপর নানা রকম বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাই বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন বায়োসিমেন্ট, যা মূলত বর্জ্য হতে তৈরি সিমেন্ট।
সিমেন্ট উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপেই পরিবেশের উপর কিছু বিরূপ প্রভাব পড়ে। সিমেন্ট উৎপাদনের সময় শব্দদূষণ এবং ধূলা, ধোঁয়ার মতো বায়ুদূষণকারী পদার্থ তৈরি হয়। এছাড়া সিমেন্ট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পাথর, বালি ও অন্যান্য উপাদান সংগ্রহের জন্য খননের মাধ্যমে ভূমির ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। সিমেন্ট তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যতম উপাদান চুনাপাথর বা লাইমস্টোন; যা পরিবেশে স্বল্প পরিমাণে মজুদ আছে এবং একবার নিঃশেষ হলে আর পাওয়া যাবে না।
তবে প্রচলিত সিমেন্টের বিকল্প হিসেবে পরিবেশের জন্য উপযোগী এক ধরনের বায়োসিমেন্ট উৎপাদনের পদ্ধতি বের করেছেন Nanyang Technological University, Singapore (NTU Singapore) এর একদল গবেষক এবং অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এই বায়োসিমেন্ট হচ্ছে বর্জ্য হতে তৈরি সিমেন্ট।
এটি হচ্ছে মূলত এক ধরনের নবায়নযোগ্য সিমেন্ট যা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা বিক্রিয়া ঘটানোর মাধ্যমে মাটিকে শক্ত ও নিরেট ব্লকে পরিণত করে।
বর্তমানে NTU গবেষকগণ দুই ধরনের বর্জ্য পদার্থ অর্থাৎ, স্তন্যপায়ীদের মূত্রের ইউরিয়া এবং শিল্পকারখানার কার্বনযুক্ত কালো থকথকে বর্জ্য পদার্থ হতে বায়োসিমেন্ট প্রস্তুত করেছেন। চেয়ার অফ দ্যা স্কুল অফ সিভিল অ্যান্ড এনভাইরনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রফেসসর শু লিয়ান এর প্রতিনিধিত্বে কাজ করে যাচ্ছে গবেষণা দলটি। Environmental Chemical Engineering এ প্রকাশিত গবেষণাপত্র হতে জানা যায় যে, তাদের তৈরিকৃত বায়োসিমেন্ট ভূমি উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। বায়োসিমেন্টের মাধ্যমে নির্মাণ কাজের জন্য মাটিকে শক্ত করা, সমুদ্রতীরের ভাঙনরোধ, মরুভূমিতে ধূলো ও বায়ুপ্রবাহের কারণে ভূমিধ্বস কমিয়ে আনা, মরুভূমিতে কিংবা সমুদ্রতীরে বিশুদ্ধ পানির চৌবাচ্চা তৈরি করা যেতে পারে। এছাড়াও বায়োসিমেন্টের মাধ্যমে পাথরের ফাটল এবং ভাস্কর্যের মেরামতও করা যাবে।
আরোও পড়ূনঃ সিমেন্ট খেলে কী কী সমস্যা হতে পারে?
প্রফেসসর শু জানান,
“মূত্র, ব্যাকটেরিয়া এবং ক্যালসিয়ামের বিক্রিয়া ঘটানোর মাধ্যমে তৈরি করা যাবে সাশ্রয়ী এবং নবায়নযোগ্য এই বায়োসিমেন্ট। সাধারণ সিমেন্ট উৎপাদনের একটি ধাপে কাঁচামালগুলোকে ঝামার মধ্যে ১০০০° সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় পোড়াতে হয় যা প্রচুর কার্বণ নিঃসরণ ঘটায়। অন্যদিকে বায়োসিমেন্ট কক্ষ তাপমাত্রায় কোনো কিছু পোড়ানো ছাড়াই তৈরি করা যায় যা পরিবেশবান্ধব, কম শক্তি ব্যয়কারী এবং প্রায় কার্বন নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া।”
গবেষণা দলটির মতে যদি বায়োসিমেন্টের উৎপাদন বর্তমানে ব্যবহৃত সাধারণ সিমেন্টের উৎপাদনের পর্যায়ে নেওয়া যায়, তবে বায়োসিমেন্ট উৎপাদনের সর্বোপরি খরচ সাধারণ সিমেন্টের চেয়ে বহুগুণে কম হবে। একই সাথে এটি পরিবেশকে কার্বনের হাত থেকে রক্ষা করবে এবং নবায়নযোগ্য হওয়ায় সাধারণ সিমেন্টের অন্যতম বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
বর্তমানে গবেষণা দলটি সিঙ্গাপুর এর ন্যাশনাল অ্যাজেন্সি গুলোর সাথে মিলিত হয়ে প্রতিনিয়ত East Coast Park এর সমুদ্রতীরের বালিকে শক্ত করার জন্য বায়োসিমেন্ট স্প্রে করার মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা চালাচ্ছেন।
অদূর ভবিষ্যতে বায়োসিমেন্টের ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশকে কার্বন দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর মাধ্যমে একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ভূমিকা রাখবে, ঠিক তেমনি নবায়নযোগ্য হওয়ায় সিমেন্ট তৈরিতে ব্যবহৃত লাইমস্টোন সংরক্ষণেও সাহায্য করবে। একইসাথে পরিবেশে ফেলে দেওয়া বর্জ্যপদার্থ কাজে লাগানোর মাধ্যমে পরিবেশকে আরো সুন্দর এবং সতেজ করে তোলা সম্ভব হবে।
দিদারুল ইসলাম/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: Scitechdaily, Tech Xplore
+1
+1
+1
+1
+1
+1
+1