প্রতি সেকেন্ডে কোটি কোটি নিউট্রিনো আমাদের শরীরকে অতিক্রম করছে। কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারছিনা। কারণ নিউট্রিনো বলতে গেলে কোন কিছুর সাথে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। পরমাণুর সাথে নিউট্রিনোর ইন্টারঅ্যাকশন ঘটার বিষয়টি খুবই দুর্লভ। সাধারণভাবে আলোর ফোটন আমাদের শরীরে পড়লে সেটা বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে আমরা ছায়া দেখতে পাই। যার ফলে খুব সহজেই ফোটনের উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি। কিন্তু নিউট্রিনোর আচরণ একদমই ভিন্ন।
জেনে অবাক হবেন, এটি দৃশ্যমান বস্তু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত তো হয়-ই না, এমনকি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স, স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স দ্বারাও প্রভাবিত হয় না। যার জন্য নিউট্রিনো ডিটেক্ট করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি একটি নিউট্রিনো নিক্ষেপ করে এর সামনে ১ আলোকবর্ষ পুরুত্বের একটি লেডের প্রাচীর রাখেন, তবে নিউট্রিনোটি এই লেডের প্রাচীরের সাথে প্রতিক্রিয়া দেখানোর সম্ভাবনা 50-50 । অর্থাৎ, Neutrino-টির বিনা বাধায় এই লেডের প্রাচীর ভেদ করার সম্ভাবনা 50%। এজন্যই নিউট্রিনো কে বলা হয় “গোস্ট পার্টিকেল” বা “ভুতুড়ে কণা”।
নিউট্রিনো নিয়ে স্টাডি করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিশাল বিশাল নিউট্রিনো ডিটেক্টর স্থাপন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। যেন বেশি সংখ্যক নিউট্রিনো ডিটেক্ট করা যায় এবং নিউট্রিনো নিয়ে স্টাডি করা যায়। কারণ নিউট্রিনো সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে পারলে মৌলিক অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে। যেমন: বিগ ব্যাং এর পর সমান পরিমান ম্যাটার ও অ্যান্টি ম্যাটার তৈরি হয়েছে, তবে বর্তমানে কেন আমরা শুধুমাত্র ম্যাটার দেখতে পারি। তাছাড়া এখন পর্যন্ত মানুষ যে সমস্ত মৌলিক কণার সম্পর্কে জেনেছে, এদের মাধ্যমে মহাবিশ্বের মাত্র 5% ব্যাখ্যা করা যায় বাকি 95% অর্থাৎ ডার্ক ম্যাটার। ডার্ক এনার্জি ইত্যাদি সম্পর্কে জানার জন্য জানার ক্ষেত্রে নিউট্রিনো নতুন দ্বার উন্মোচন করতে পারে ।
নিউট্রিনো সম্পর্কে ইতিকথা:
অগ্রসরমান বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ আমরা জানি প্রোটন ও নিউট্রন কোনো মৌলিক কণা নয়। এ দুটোই গঠিত কোয়ার্ক দিয়ে। ইলেকট্রন, প্রোটন, ও নিউট্রন নিয়ে মহাবিশ্বের সকল কিছু গঠিত বলে ধরা হত। তাঁর মাঝে ইলেকট্রনই শুধু আজ পর্যন্ত মৌলিক কণা হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল যে পরমাণু বা মহাবিশ্বের সকল কিছু শুধু ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে গঠিত। তিরিশের দশকের গবেষণায় বিজ্ঞানীরা নিউট্রন নিয়ে গবেষণা করতে করতে এক সময় একটি অজানা কণার ধারণা পান।
পরমাণু থেকে নিউট্রনকে অবমুক্ত করে রাখলে দেখা যায় নিউট্রনটি আর নিউট্রন থাকছে না। সেটি ভেঙ্গে নিজেকে পাল্টে নিচ্ছে ইলেকট্রন ও প্রোটনে। এই পাল্টানোর সাথে সাথে তাঁর ভরেরও পরিবর্তন হয়। আদি অবস্থায় যে ভর ছিল তা থাকে না, কমে যায়। যদি কমেই যায় তবে সে গেল কই? ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে বাধ্য হয়েই একটি অজানা কণার অস্তিত্ব ধরে নিতে হয়। ১৯৩১- বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি নিউট্রিনোর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করেন ও ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং ১৯৩২- এনরিকো ফার্মি এর নাম দেন নিউট্রিনো ।
নিউট্রিনোর সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার হল এর দুর্দমনীয় গতি। এটি আলোর বেগে ছুটে চলে। সাধারণ কোনো আলোর কণা যখন ছুটে চলে তখন পথিমধ্যে কোনো অস্বচ্ছ বাধা বা প্রতিবন্ধকতা পড়লে আলো আর তা ভেদ করে যেতে পারে না, বড়জোর প্রতিফলিত হয়। কিন্তু নিউট্রিনো এমন এক আজব জিনিস যেটার সামনে হাজার প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তা ভেদ করে অনায়াসে চলে যেতে পারে। নিউট্রিনোর এই দুর্দমনীয় গতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটা ধাঁধার সম্মুখীন হতে হয় বিজ্ঞানীদের। যদি নিউট্রিনোর ভর থাকে তবে সে আলোর বেগে ছুটে কি করে? ভর থাকলে তো আলোর বেগে ছুটা সম্ভব নয়। কোনো কণার ভর যদি শূন্য হয় তবে তাকে অবশ্যই আলোর বেগে ছুটতে হবে, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
পরে অবশ্য এই সমস্যার সমাধান হয়েছে। কয়েক প্রকারের নিউট্রিনো আবিষ্কার হয়েছে। কারো কারো ভর আছে আবার কারো নেই।
নিউট্রিনো:
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুসারে তিন শ্রেণীর কণা দ্বারা গঠিত। সেগুলো হলো – ১.কোয়ার্ক ২. বোসন এবং ৩. লেপটন।
এদের মধ্যে লেপটন আবার দুই প্রকার। যথা: ইলেকট্রন এবং নিউট্রিনো। নিউট্রিনোর কোন চার্জ নেই। যেহেতু এর কোন চার্জ নেই, সেহেতু এটি কোন চৌম্বক ক্ষেত্র, বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয় না। আর এ কারণেই নিউট্রিনো নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। চার্জহীন বলেই এর নামকরণ করা হয়েছে নিউট্রিনো। সহজ বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় চার্জহীন অতি ক্ষুদ্র কণা। গ্রিক অক্ষর ν (নিউ) দ্বারা একে প্রকাশ করা হয়। নিউট্রিনো তিন প্রকার।
নিউট্রিনো এবং নোবেল পুরস্কার:
এখন পর্যন্ত বহু বিজ্ঞানী এই মৌলিক কণা নিয়ে কাজের জন্য ১৯৮৮, ১৯৯৫, ২০০২ ও ২০১৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এতগুলো নোবেল পুরস্কার এর একমাত্র কারণ কণাটির রহস্যময়তা এবং আগামীতেও বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করবেন। একটি রহস্যের সমাধান হতে না হতেই তার হাত ধরে দশটি রহস্য সামনে এসে হাজির হচ্ছে ।
একইসাথে, প্রতিটি রহস্যের সমাধানের সাথে সাথে উন্মোচিত হচ্ছে পদার্থবিদ্যা ও মহাকাশ বিজ্ঞানের অনেক অজানা রহস্য।
নিজস্ব প্রতিবেদক/ মোঃ গালীব হাসান
তথ্যসূত্র: CNN | Ghost Particle