রাস্তায় যানজটে ফেঁসে গেলে, অনেক সময়ই মনে হয়, উড়ে চলে যেতে পারলে বেশ ভালোই হতো। অনেকেই হয়তো “হ্যারি পটার অ্যান্ড চেম্বার অব সিক্রেটস” এর উড়ন্ত গাড়ি-র কথা মনে মনে ভাবছেন। এতদিন তা কল্পনা হলেও, সেই স্বপ্নই এবার বাস্তব হতে যাচ্ছে ৷ যেভাবে কল্পবিজ্ঞানকে বাস্তবের রূপ দিতে, গাড়িকে নীল আকাশের বুকে ওড়ানোর চেষ্টায় দিন-রাত এক করছে বিভিন্ন সংস্থা, তাতে স্বপ্ন সফল হওয়ার জন্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। প্রত্যেকদিন যানজটের মুখোমুখি হওয়ার লড়াই এবার সম্ভবত শেষ হতে চলেছে।
কয়েকটা সুইচের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসবে ডানা। হঠাৎই বিমানে পরিণত হবে চার-চাকার গাড়ি। এমনই হাইব্রিড “কার-এয়ারক্রাফট” যার নাম “এয়ারকার (AirCar)” বানিয়েছেন ক্লেইন ভিশনের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও স্লোভ্যাক ইউনিভার্সিটির হেড অব ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট এন্ড ডিজাইনের (AFAD) প্রফেসর স্টেফান ক্লেইন এবং তাঁর সহকারী অ্যান্টন জেজাক।” আর সেই গাড়ি নিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন মহলে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে।
কারণ ক্লেইন ভিশন সংস্থার এই গাড়িটি বিশ্বের প্রথম পেট্রোল দ্বারা চালিত (Petrol Powered Flying Car) উড়ন্ত গাড়ি, যার মধ্যে একটি বিএমডব্লিউ (BMW) ইঞ্জিন রয়েছে। যা মূলত পেট্রোলে চলে।
অধ্যাপক ক্লেইন বলেন, এই গাড়িটি ৮ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে। গাড়িটি এখন পর্যন্ত ৪০ ঘণ্টা আকাশে উড়েছে।
তিনি আরোও জানান, এই গাড়িটি এয়ারক্রাফটে পরিণত হতে ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ড সময় লাগে। গাড়ির দরজার সঙ্গে রয়েছে সরু দুটি পাখা। যা একে উড্ডয়নে সহায়তা করে। পরীক্ষামূলকভাবে তিনি রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন করে এক শহর থেকে আরেক শহরে যান। আমন্ত্রিত রিপোর্টাররা এই দৃশ্য দেখেন। নিজের এই উড্ডয়নের অভিজ্ঞতাকে স্বাভাবিক এবং বেশ আনন্দদায়ক বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।
ক্লেইন ভিশনের এই উড়ন্ত গাড়িটি তার প্রতিযোগীদের থেকে বাস্তবসম্মত উপায়ে অনেকটাই এগিয়ে। গত বছর জুনেই স্লোভাকিয়ান শহর থেকে নিতারা (ব্রাতিসলাভার রাজধানী) পর্যন্ত ৬০ মাইলের উড্ডয়ন সফলভাবে অতিক্রম করেছিল এবং সমগ্র পথটুকু গাড়িটি উড়ে গিয়েছিল। এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পরপরই গাড়িটির সুইচ মোড অন করা হয় যার ফলে চাকার সাহায্যেই শহরে রাস্তায় চলছিল গাড়িটি। নিরাপত্তা এবং পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতে অনেকগুলি টেস্টিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় উড়ন্ত গাড়ি-টিকে, যার সবগুলিই সফল ভাবে করতে সক্ষম হয়েছে “এয়ারকার (AirCar)”।
বিবিসির এক রিপোর্ট থেকে সম্প্রতি জানা গিয়েছে যে,
গাড়ির জগতের আরেকটি মাইলফলক (Milestone) স্লোভাকিয়ার স্লোভাক ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (Slovak Transport Authority) এরই মধ্যে ৭০ ঘণ্টার ফ্লাইট টেস্ট করে দেখেছে এই গাড়িটির। তারপরই ইউরোপিয়ান অ্যাভিয়েশন সেফটি এজেন্সি এটিকে উড়ন্ত গাড়ি (Flying car) হিসেবে ছাড়পত্র দেয় এবং স্লোভাকিয়ার সরকারও এটিকে কমার্শিয়ালি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। অর্থাৎ গাড়িটি বিক্রি হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছে।
রয়্যাল অ্যারোনটিক্যাল সোসাইটির এয়ারওয়ার্ডিনেস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স স্পেশালিস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান কিরিয়াকোস কৌরোসিস সিএনএনকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এটিই প্রথমবার নয় যে এই ধরনের যানবাহন প্রত্যয়িত হয়েছে। এটি এমন একটি স্কেল যা কর্মসংস্থানের জন্য এবং নতুন প্রযুক্তির বিকাশের জন্য অনেক নতুন সুযোগ তৈরি করতে চলেছে।”
সাধারণ মানুষ কি এই এয়ারকার (AirCar) ব্যবহার করতে পারবে?
ক্লেইন ভিসন-এর এই এয়ারকার উড়ন্ত গাড়িটি এমনই একটি গাড়ি, যার কার্যকারিতা রয়েছে বৃহত্তর জনগণের পরিষেবার জন্য এবং শুধুমাত্র অতি ধনী এবং বিখ্যাতদের জন্যই এটি একটি বিকল্প হিসেবে মনে করলে চলবে না বলে সংস্থার তরফ থেকে জানানো হয়েছে। এয়ারকারের ডুয়াল মোবিলিটি ক্যারেক্টার সাহায্য করতে পারে যে কোনও শহরের বড় রাস্তায় যখন খুবই ভিড়ভাট্টা থাকবে, তখন খুব সহজেই তা এড়াতে সাহায্য করবে চালককে। পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতেও ব্যাপক ভাবে সহায়ক হতে পারে এয়ারকার।
এমন অনেক সমালোচকও আছেন যারা আকাশপথে যানজটের সম্ভাবনা এবং কীভাবে এয়ার লেনের গতিবিধি সংজ্ঞায়িত করতে হবে তা নির্ধারণে তর্ক করে চলেছেন, তখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে উড়ন্ত গাড়িগুলি হেলিকপ্টারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তার ফলে যে সুবিধা হতে পারে তা হল, হেলিকপ্টার রাস্তাঘাটে চলতে পারে না। কিন্তু এই উড়ন্ত গাড়ি কাউকে দূরবর্তী স্থান আকাশপথে থেকে উড়িয়ে নিয়ে এসে আবার রাস্তা দিয়ে যাতায়াতেরও সুবিধা করে দেবে।
এয়ারকার (AirCar) ফিচার্স:
ক্লেইন ভিসন-এর এই উড়ন্ত গাড়ি এয়ারকারের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১৭০ কিলোমিটার। এই ফ্লাইং কার ১০০০ কিলোমিটার এরিয়াল ডিসট্যান্স কভার করতে পারে ৮,২০০ ফুট উচ্চতায়। সংস্থার তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, এই এয়ারকার কিছু ইন-এয়ার ম্যায়ানুভারেও সক্ষম। এই উড়ন্ত গাড়িটির পাওয়ারের দিকটি নিশ্চিত করতে এতে ১৪০ এইচপি ১.৬ লিটারের চারটি সিলিন্ডারের বিএমডব্লিউ (BMW) ইঞ্জিন বসানো হয়েছে। এতে ফিক্সড প্রপেলার রয়েছে এবং সেই সঙ্গে দেওয়া হয়েছে ব্যালিস্টিক প্যারাশ্যুটও।
তবে অন্যান্য ড্রোন-ট্যাক্সি প্রোটোটাইপের মতো এটি খাড়াখাড়িভাবে উড়তে বা অবতরণ করতে পারে না। বরং এটির উড্ডয়ন বা অবতরণ করতে রানওয়ে প্রয়োজন। আকাশে ওড়ার জন্য এয়ারকারের লাগবে মাত্র ৩০০ মিটার রানওয়ে। তাছাড়া, এটি ২০০ বারের বেশি উড্ডয়ন ও অবতরণ করেছে। যেকোনো স্পোর্টসকারের মতো এতেও অন্তত ২ জন বসতে পারবেন। এখন পর্যন্ত ২০০ কেজি পর্যন্ত মালামাল পরিবহনে সক্ষম বলে জানা গিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চলে আসলেও কেউ ভাবতে পারেনি এমনটা এত দ্রুতই দেখা যাবে। এবার সে অসম্ভব কাজ সম্ভব এ পরিণত হল তাও আবার চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে। আকাশপথ এবং স্থলপথে চলমান এই এয়ারকার তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মানুষের কার্যক্রমকে গতিশীল করতে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ক্লেইন ভিশন প্রথম সংস্থা হিসেবে পেট্রোল দ্বারা চালিত উড়ন্ত গাড়ি বাজারে নিয়ে আসলেও পাশাপাশি আরও একাধিক সংস্থা ভবিষ্যত প্রজন্মের উড়ন্ত গাড়ি নিয়ে কাজ করছে।
২০১৬ সালে, উবার একটি উড়ন্ত ট্যাক্সির একটি প্রোটোটাইপ উন্মোচন করেছিল যা দেখতে ড্রোনের মতো ছিল। জার্মান ফ্লাইং-ট্যাক্সি স্টার্টআপ লিলিয়াম (German flying-taxi startup Lilium) এখন পর্যন্ত ৩৬৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় সাড়ে ৩১ কোটি টাকা সমমূল্যের চাহিদা আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গিয়েছে৷
উড়ন্ত গাড়ির চাহিদা সামনে বাড়বে বলে মনে করছে মার্কেট বিশেষজ্ঞরা। ২০১৯ সালে কনসালটেন্ট কোম্পানিমরগান স্ট্যানলি পূর্বাভাস করে যে, ২০৪০ সাল নাগাদ ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের খাতে পরিণত হতে পারে এই শিল্প।
রাস্তায় যে ভাবে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে আর যানজটের প্রবণতা তৈরি হচ্ছে তাতে এই “ফ্লায়িং কার বা উড়ন্ত গাড়ি” নতুন দিশা দেখাতে পারবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই গাড়িকে ফ্লাইং কার বলা হলেও এগুলি রাস্তাতেও অর্থাৎ সড়কপথে ও আকাশপথে সমান ভাবে চলতে পারবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক/মোঃ আজহার সিদ্দিক মেহরাজ
তথ্যসূত্রঃ BBC, CBS News, The Business Standard
+1
+1
+1
1
+1
+1
+1
+1