আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের এক নতুন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের এক তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হিসাবে দেখেন।
জরিপে দেখা গিয়েছে, মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন। আরও ৪৫ শতাংশ বলেছেন যে এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক প্রভাব উভয়ই রয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী দুই তৃতীয়াংশ মানুষ বিশ্বাস করেন যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের সাথে সম্পর্কিত।
হতাশার সাথে সামাজিক মাধ্যমের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণায় একটি শক্তিশালী অংশ রয়েছে। অন্যান্য গবেষণাগুলো এটিকে হিংসা, হীনমন্যতা এবং সামাজিক উদ্বেগের সাথও যুক্ত করেছে।
অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাবহার ও এর প্রতিক্রিয়া ও বিপদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং ছাত্রছাত্রীদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার ভুল ব্যবহার পর্যবেক্ষণকারী জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের উপঅধ্যাপক, জেলেনা কেচম্যানোভিচ বাস্তব জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসের জন্য ছয়টি পরামর্শ দিয়েছেন !
১. আপনি কখন কোথায়,কতক্ষণ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছেন তা সীমিত করুন:
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার আপনার ব্যক্তিগত সরাসরি যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি এবং হস্তক্ষেপ করতে পারে। আপনি বাস্তব জীবনে মানুষের সাথে আরো ভালোভাবে যোগাযোগ করতে পারবেন যদি আপনি প্রতিদিনের কিছু নির্দিষ্ট সময় আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখেন বা আপনার মোবাইলে ফ্লাইট মোড দিয়ে রাখেন। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে খাবার সময়, বাচ্চাদের সাথে খেলার সময় বা যেকোনো বন্ধু বা পার্টনারের সাথে কথা বলার সময় সামাজিক মাধ্যম না ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিন।
লক্ষ্য রাখুন সোশ্যাল মিডিয়া আপনার কাজে যেন অযাচিত প্রভাব না ফেলে এবং সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ বা কোন প্রকল্পের কাজে যেন ব্যাঘাত না ঘটায়। আর আপনার ফোন এবং কম্পিউটারকে আপনার বেডরুমে রাখবেন না, এটি আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে।
২. ডিটক্স (Detox) পিরিয়ড নির্দিষ্ট করুন :
সামাজিক মাধ্যম থেকে নিয়মিত দীর্ঘ দিনের বিরতি নির্ধারণ করুন। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে ফেসবুক থেকে ৫ দিন বা সপ্তাহব্যাপী বিরতি আপনাকে কম চাপ এবং জীবন সম্পর্কে উচ্চতর সন্তুষ্টি এনে দিতে পারে। অথবা আপনি যদি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে নাও চান, সেক্ষেত্রে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার প্রতিদিন খুবই কম সময়, ধরুন ৫০ মিনিটের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। এভাবে তিন সপ্তাহের মত চেষ্টা করুন, হয়তো এটা শুরুতে বেশ কঠিন মনে হবে, তাই আপনি পরিবার ও বন্ধুদেরকে খোলাখুলিভাবে বলে সহায়তা চাইতে পারেন এবং সাথে অবশ্যই আপনার ফোন থেকে সংশ্লিষ্ট সময় নষ্টকারী অ্যাপগুলো ডিলেট করে দিন।
৩. আপনি কি করছেন এবং কেমন অনুভব করছেন তার দিকে মনোযোগ দিন:
দিনের বিভিন্ন সময়ে আপনার প্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি ভিন্ন ভিন্ন সময় ব্যবধানে ব্যবহার করুন। প্রতিবার ব্যবহারের সময় এবং তারপরে লক্ষ্য করুন আপনার কেমন অনুভব হচ্ছে। আপনি হয়ত খেয়াল করবেন, অল্প অল্প করে ব্যবহার করায় একটানা দীর্ঘসময় ধরে স্ক্রল করার থেকে ভালো বোধ হচ্ছে।
এবং যদি আপনি লক্ষ্য করেন, প্রতিরাতে এসব মাধ্যম ব্যবহারের পর আপনি হতাশ হয়ে পড়েন এবং নিজের সম্পর্কে খারাপ বোধ করেন, তবে রাত ১০ টার পর সকল সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করুন। অধিকাংশ ব্যাবহারকারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিষ্ক্রিয় ভাবে ব্যবহার করে এবং শুধুমাত্র অন্যের পোস্টগুলি ব্রাউজ করে এবং দেখে যায়। যখনই সম্ভব আপনার অনলাইন ইন্টারএকশন গুলোকে ফোকাস করুন এমন লোকদের মাঝে, যাদের আপনি অফলাইনেও জানেন।
৪. চিন্তা করে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করুন, নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন আপনি কেন ব্যবহার করছেন :
যদি সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আপনার প্রথম কাজ হয় ফেসবুক চেক করা, তবে নিজেকে প্রশ্ন করুন কেন আপনি এটা করছেন? এটা কি পুরো দিনের শুরুর আগে ব্রেকিং নিউজগুলো জানার জন্য নাকি সামনের দিনটির মুখোমুখি হওয়া থেকে পালানোর একটা অযথা চেষ্টা?
আপনি কি লক্ষ্য করেছেন যখনই আপনি কোনো কঠিন কাজের মুখোমুখি হচ্ছেন তখনই আপনি এই মাধ্যমগুলো চেক করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন? নিজের সাথে সাহসী ও নির্মমভাবে সৎ হন। প্রতিবার সোশ্যাল মিডিয়া চেক করতে যাবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন আপনি এখন এটা করছেন। নিজেই নির্ধারণ করুন এটি কি আপনার জীবনে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলছে কিনা।
৫. ছাঁটাই :
সময়ের সাথে সাথে আপনি অনেক অনলাইন বন্ধু, ব্যক্তি ও সংস্থার সাথে যুক্ত হয়েছেন। এর কিছু কিছু আপনার কাছে এখনো আকর্ষণীয়, কিন্তু বেশিরভাগ বিষয়ই বিরক্তিকর হয়ে পড়েছে। তাই এখন আপনার সময় এসেছে এসব বিষয়কে আনফলো বা সরিয়ে ফেলার, যা আপনার জন্য ভালো ফলাফল নিয়ে আসবে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ফেসবুকের অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় বন্ধুদের জীবনযাপন সম্পর্কিত তথ্যগুলো নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে।
যাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে অনুপ্রেরণামূলক গল্প গুলো বেশি ছিল তারা তাদের জীবনে এর প্রভাব হিসেবে কৃতজ্ঞতা, জীবনীশক্তি ও বিস্ময় এর প্রকাশ (অভিজ্ঞতা) বেশি পেয়েছিল। তাই কিছু “বন্ধু” ছাঁটাই করে তার পরিবর্তে অনুপ্রেরণামূলক বা মজার সাইট অনুসরন করার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করতে পারেন!
৬. সোশ্যাল মিডিয়াকে আপনার বাস্তব জীবনকে প্রতিস্থাপিত করতে দিবেন না :
ফেসবুকে আপনার চাচাতো ভাইবোনদের খোঁজখবর রাখা কখনোই সমস্যার কারন হবেনা, যদিনা আপনি কয়েকমাস পর পরই তাদের সাথে দেখা করতে যান। সহকর্মীর সাথে ম্যাসেজিং, টেক্সটিং করা হতে পারে মজার বিষয়, কিন্তু লক্ষ্য রাখুন যেন সেটি মুখোমুখি যোগাযোগের বিকল্প না হয়ে যায়।
যখন আপনি চিন্তা করেন এবং পরিমিতভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন, তখন এটি আপনার প্রতিদিনের জীবনে, কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী ভূমিকা রাখতে পারবে।
কিন্তু মৌলিক মানবিক অনুভূতির প্রকাশের জন্য আপনার পাশে একজন রক্তমাংসের মানুষই প্রয়োজন হবে!