বিজ্ঞানীদের একটি দল 3D মুদ্রণ বা 3D প্রিন্টিং কে আরও পরিবেশবান্ধব করার জন্য মাইক্রোঅ্যালগি নামক অণুজীব ব্যবহার করে কালি তৈরি করেছেন, যেটি মূলত স্বাদু পানি বা সমুদ্রে পাওয়া এক প্রকার আণুবীক্ষণিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, যা মাইক্রোঅ্যালগি নামেও পরিচিত, এটি স্থলজ উদ্ভিদের অনুরূপ ক্লোরোফিল ধারণ করে ও বাঁচতে এবং বৃদ্ধি পেতে সূর্যালোকের প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন উচ্ছল এবং সমুদ্রের উপরের অংশে ভেসে বেড়ায়, যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে।
মাইক্রোঅ্যালগি হলো একক কোষীয় ফটোসিন্থেটিক অণুজীব যা সাধারণত জলজ পরিবেশে বৃদ্ধি পায়। এই অণুজীবগুলো বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং জৈব অণুতে রূপান্তর করে, যা একটি অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া!
3D প্রিন্টিং বা অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া যা এক স্তরের উপর আরেকটি স্তর গঠন অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সংযুক্ত করে বিভিন্ন ধরনের বস্তু তৈরি করে। সাধারণত, এই প্রক্রিয়া তরল কালি বা রেজিন (কোনো প্রাকৃতিক বা সিন্থেটিক জৈব যৌগ যা সান্দ্র বা আঠালো তরল পদার্থ নিয়ে গঠিত) ব্যবহার করে, যা লেজার বা আলো দ্বারা শক্ত ও পূর্ণাঙ্গ পদার্থে রূপান্তরিত হয়। এই প্রযুক্তি বর্তমানে বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে যেমন মেডিকেল ডিভাইস, অটোমোটিভ শিল্প, মহাকাশ প্রযুক্তি, এবং এমনকি মডুলার বাড়ি তৈরিতেও।
3D প্রিন্টিং প্রযুক্তি বিশেষ করে শিল্পে বিভিন্ন ধরনের জটিল অংশ তৈরি করতে সহায়তা করে, যা অত্যন্ত কার্যকরী এবং কাস্টমাইজেবল বা স্বনির্ধারিত। উদাহরণস্বরূপ, এটি মেডিকেল ডিভাইস যেমন কাস্টমাইজড ইমপ্লান্ট এবং অটোমোটিভ শিল্পে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির জটিল অংশ তৈরি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বর্তমান 3D প্রিন্টিং কালি এবং রেজিন সাধারণত তেলভিত্তিক উপাদান এবং রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশবান্ধব নয়। এই কালি এবং রেজিন পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে বিষাক্ত হতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য বিজ্ঞানীরা আরও পরিবেশবান্ধব বিকল্পের সন্ধান করছেন। এক্ষেত্রে, মাইক্রোঅ্যালগি একটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে। মাইক্রোঅ্যালগি একটি প্রাকৃতিকভাবে নবায়নযোগ্য উপাদান, যা পরিবেশের জন্য তুলনামূলক কম ক্ষতিকর। এই নতুন প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে, যা বর্তমান 3D প্রিন্টিং কালি এবং রেজিনের পরিবেশগত সমস্যাগুলো সমাধান করতে সহায়তা করবে!
মাইক্রোঅ্যালগির লিপিড, বিশেষত ট্রাইগ্লিসারাইড, 3D প্রিন্টিংয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই লিপিডগুলো উচ্চ মাত্রার ফ্যাটি অ্যাসিড দ্বারা গঠিত, যা অতিরিক্ত পরমাণু বা রেডিক্যালের সাথে যুক্ত হতে সক্ষম। এই ডাবল বন্ডযুক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো প্রিন্টেবল বিভিন্ন পদার্থের সাথে ফাংশনালাইজেশন করা যেতে পারে, যা প্রিন্টিং প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। মাইক্রোঅ্যালগির এই লিপিডের উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং দ্রুত বৃদ্ধি এটিকে আরও সম্ভাবনাময় করে তুলেছে।
বিজ্ঞানীদের গবেষণা-
ইভা ব্লাসকো, জার্মানির হেইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং 3D Matter Made to Order (3DMM2O) এক্সেলেন্স ক্লাস্টারের প্রধান, বলেছেন,
“মাইক্রোঅ্যালগি থেকে প্রাপ্ত এক্সট্র্যাক্টগুলো 3D প্রিন্টিংয়ের জন্য উচ্চ রেজোল্যুশনের কালি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা ‘টু-ফোটন 3D লেজার প্রিন্টিং’ প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রিন্ট করা হয়।”
ব্লাসকো আরও উল্লেখ করেন যে, মাইক্রোঅ্যালগি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন সবুজ রঙ্গক ধারণ করে যা সাধারণ ফটোইনিশিয়েটরদের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে।
”ফটোইনিশিয়েটর” হল একটি রাসায়নিক যৌগ যা আলোর শক্তি শোষণ করে এবং একটি রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া শুরু করে। এই প্রতিক্রিয়াটি সাধারণত পলিমারাইজেশন বা ক্রসলিঙ্কিং নামে পরিচিত, যা প্লাস্টিক, রেজিন এবং আঠা তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রচলিত ফটোইনিশিয়েটিং প্রায়ই বিষাক্ত হতে পারে। মাইক্রোঅ্যালগির নিজস্ব রঞ্জক ব্যবহারের ফলে পরিবেশবান্ধব 3D প্রিন্টিংয়ের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়।
গবেষণা দলটি মাইক্রোঅ্যালগি ভিত্তিক কালি পরীক্ষায় সফলভাবে সাব-মাইক্রন রেজোল্যুশনের 3D মাইক্রোস্ট্রাকচার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এটি বর্তমানে ব্যবহৃত 3D প্রিন্টিং কালি এবং রেজিনের তুলনায় কার্যকরী।
ক্লারা ভাজকুয়েজ-মার্শাল, গবেষণার প্রথম লেখক, বলেন,
“আমরা দুটি প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি ব্যবহার করেছি, O. aurita এবং T. striata, যা এই পদ্ধতির কার্যকারিতা এবং বৈচিত্র্য প্রদর্শন করে।”
মাইক্রোঅ্যালগি ভিত্তিক কালি স্কেল আপ করা সহজ এবং এটি ল্যাবের বাইরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।
ভাজকুয়েজ-মার্শাল বলেন,
“স্প্যানিশ ব্যাংক অফ অ্যালগির আমাদের অংশীদাররা বিভিন্ন আকারের ফোটোবায়োরিয়াক্টর এবং আরও বৃহৎ আকারে উৎপাদনের জন্য রেসওয়ে-টাইপ কালচার ট্যাঙ্ক গুলোর সাথে ইতোমধ্যেই কাজ করছে।”
মাইক্রোঅ্যালগি দিয়ে 3D প্রিন্টিং প্রযুক্তির উন্নয়ন পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই প্রযুক্তির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মাইক্রোঅ্যালগির নবায়নযোগ্যতা, নিম্ন পরিবেশগত প্রভাব, এবং টেকসই উৎপাদন ক্ষমতা এই প্রযুক্তির ভবিষ্যতের জন্য একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। এই নতুন প্রযুক্তির বাস্তবায়ন বিশ্বের 3D প্রিন্টিং শিল্পে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে এবং পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে সহায়তা করতে পারে। এভাবে, মাইক্রোআলগি ভিত্তিক 3D প্রিন্টিং প্রযুক্তি পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করছে।
আমিনুল ইসলাম সিয়াম / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: অ্যাডভান্সড সায়েন্স নিউজ, থ্রিডিনেটিভস.কম, সায়েন্স ডিরেক্ট