গত কয়েকদিনে অনলাইনে সবার আলোচনার অন্যতম বিষয় হলো জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এর “ফার্স্ট ডীপ ফিল্ড” ইমেজ। পৃথিবী সৃষ্টির আগের গভীর মহাশুন্যের হাজার হাজার বছর পুরোনো গ্যালাক্সি ও ছায়াপথের ছবি তুলে পাঠিয়েছে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ।
মহাবিশ্বের এই ছবি নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়ে গেছে, ছবিটি অনেকে এডিটেড মনে করছেন, আবার আমার আপনার মত অনেকেই এর পিছনের বিজ্ঞানটা জানার আগ্রহের জন্য একসূত্রে বাধা পড়েছি। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, নাসা দাবি করছে এই ছবিগুলো মহাবিশ্বের 1350 কোটি বছর আগের। কিন্তু প্রশ্ন হলো হাজার কোটি বছর আগের ছবি জেমস ওয়েব কিভাবে তুললো? চলুন আপনাদের সাথে নিয়েই করে ফেলি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের প্রকাশিত প্রথম পাঁচটি ছবির চুলচেরা পোস্টমর্টেমঃ
গত বছরের 25 শে ডিসেম্বর 1000 কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এর উত্তরসূরী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠায় নাসা। নতুন এই টেলিস্কোপ এর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 6.5 মিটার ব্যাসবিশিষ্ট প্রতিফলক আয়না যা এর আগের হাবল টেলিস্কোপটির চেয়ে ক্ষেত্রফলের দিক দিয়ে প্রায় 6 গুণ বড় এবং 100 গুণ বেশি সংবেদনশীল।
নাসা সম্প্রতি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া 5টি ছবি প্রকাশ করেছে। যার একটি হচ্ছে ডীপ স্পেস ইমেজ যেটিতে মহাবিশ্বের প্রায় সূচনালগ্ন দেখা যাচ্ছে, অন্য একটিতে দেখা যাচ্ছে গ্যালাক্সির সংঘর্ষ। পরবর্তীতে রয়েছে এক্সোপ্লানেটের লাইটস্পেক্ট্রাম এবং বাকি দুইটির একটিতে দেখা যাচ্ছে তারার মৃত্যু ও অন্যটিতে দেখা যাচ্ছে তারার জন্ম।
বিস্তারিতঃ
SMACS 0723:
উক্ত ছবিগুলোতে যা দেখা যাচ্ছে তা এত ডিটেইলস সহ মানুষ আগে কখনো দেখেনি। ছবিগুলোর বিশেষত্ব ভালোভাবে বুঝতে এস্ট্রোফিজিক্স বা লাইটস্পেকট্রাম সম্পর্কে বেসিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এখানে প্রত্যেকটি ছবির বিশেষত্ব ও হাবল বনাম জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এর ছবির তুলনামূলক পার্থক্য সহজে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি।
এটি মহাবিশ্বের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশের সবচেয়ে শার্প এবং ডিটেইলড ইমেজ। নাসার ভাষ্যমতে একটি বালুর কনাকে অনেকে আঙ্গুলে নিয়ে আকাশের দিকে ধরলে যতটুকু আকাশ ঢেকে যাবে, এই ছবিটি হচ্ছে ততটুকু আকাশের ছবি। এই ছবিটি ক্যাপচার করতে জেমস ওয়েবে সাড়ে 12 ঘন্টা সময় লেগেছিল। এই ছবিটিতে 4.6-13.1 বিলিয়ন বছর পর্যন্ত আগের সময়ের গ্যালাক্সির ইমেজ রয়েছে। ভেবে অবাক হতে হয় এই ছবিতে ছোট ছোট যে ডট দেখা যাচ্ছে সেগুলো কোন স্টার নয় বরং এক একটা গ্যালাক্সি।
ছবিটির এই অংশে রয়েছে গ্যালাক্সি ক্লাস্টার (SMACS 0723), যা পৃথিবী থেকে প্রায় 4.6 বিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরে রয়েছে। তার মানে ছবিটিতে গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের 4.6 বিলিয়ন বছর আগের অবস্থা দেখা যাচ্ছে, যে সময়টায় আমাদের সৌরমণ্ডল কেবল তৈরি হচ্ছে।
এই SMACS 0723 গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের চারিদিকে বাঁকা রেখাগুলা দেখা যাচ্ছে, ওইগুলো মূলত হচ্ছে গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের ভরের কারণে যে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং ঘটছে, তার প্রভাবে অনেক দূরের গ্যালাক্সিগুলোর বিবর্ধিত সেই সাথে কিছুটা বিকৃত ইমেজ দেখা যাচ্ছে ছবিটিতে।
এই ছবিতে যে অংশগুলো লাল দেখাচ্ছে সেগুলো মূলত খুবই দূরের গ্যালাক্সি। আমরা জানি, যে আলো যতদূর থেকে আসে তার ততবেশি রেড শিফটিং হয় (যখন কোনো বস্তু আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তখন সেই বস্তুর আলোকে রেডশিফটিং বলে। রেডশিফটিং এর কারণে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে এবং ফ্রিকোয়েন্সি ও ফোটন এনার্জি কমতে থাকে)। বিগ ব্যাং এর ঠিক পরবর্তী মুহূর্তে মহাবিশ্বে কোন ম্যাটার ছিল না, পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে ম্যাটার তৈরি হয়েছে। তারপর তৈরি হয়েছে স্টার, তারপর গ্যালাক্সি।
এখন আমরা যত দূরে দেখতে পাব, ততোই বিগ ব্যাং এর কাছাকাছি সময়ের ছবি দেখতে পাবো। রেডশিফটিং এর কারণেই হাবলের ছবি অপেক্ষা ইনফ্রারেড লাইট ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জেমস ওয়েবের ছবি অনেক স্পষ্ট ও তথ্য বহুল। জেমস ওয়েবের ইনফ্রারেড সেন্সর এতটাই শক্তিশালী যে, চাঁদে যদি একটি মৌমাছি অবস্থান করে, তবে জেমস ওয়েবের মাধ্যমে সেই মৌমাছির শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব।
Stephan’s Quintet:
এটি হচ্ছে একটি গ্যালাক্সি গ্রুপ, যাকে বলা হয় Stephan’s quintet। এখানে 5 টি গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে। যার মধ্যে উপরে থাকা 4 টি গ্যালাক্সি পৃথিবী থেকে প্রায় 290 মিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরে অবস্থান করছে এবং নিচের দিকের গ্যালাক্সিটি মাত্র 40 মিলিয়ন লাইট ইয়ার দূরে অবস্থান করছে।
Exoplanet WASP-96 b:
এটি হচ্ছে একটি এক্সোপ্লানেটের লাইট স্পেক্ট্রাম। Exoplanet বা Extrasolar planet বলতে সৌরজগতের বাইরের যেকোন গ্রহকে বোঝায়। এক্সোপ্লানেট যখন তার স্টারের চারদিকে ঘুরে তখন ওই স্টারের আলো দেখার ক্ষেত্রে কিছুটা ডিস্টার্বেন্স তৈরি করে, যেটি পর্যবেক্ষণ করে ওই এক্সোপ্লানেট সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। জেমস ওয়েব যে এক্সোপ্লানেটি টার্গেট করেছে তার নাম wasp 96b।
জেমস ওয়েব এই এক্সোপ্লানেটটি যখন তার স্টারকে অতিক্রম করে তখন এর থেকে আসা আলোর স্পেক্ট্রাম প্রায় সাড়ে 6 ঘন্টা ধরে পর্যবেক্ষণ করেছে। যা থেকে দেখা যাচ্ছে এক্সোপ্লানেটের বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি রয়েছে। এই এক্সোপ্লানেটির ব্যাস আমাদের বৃহস্পতি থেকে কিছুটা বেশি এবং এটা সূর্যকে সাড়ে 3 দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে। এর তাপমাত্রা প্রায় 540 ডিগ্রি সেলসিয়াস। জেমস ওয়েব কিন্তু আমাদের সোলার সিস্টেম এ থাকা গ্রহগুলোকেও পর্যবেক্ষণ করবে।
Southern Ring Nebula:
এটি একটি স্টারের বিস্ফোরণের পরবর্তী অবস্থান যাকে বলে প্লানেটারি নেবুলা এবং এর নাম হচ্ছে Southern Ring Nebula বা NGC 3132। একটি স্টার বা নক্ষত্র যখন তাঁর জীবনদশার শেষ পর্যায়ে চলে আসে তখন এটিতে বিস্ফোরণ ঘটে।
Carina Nebula:
এটি হচ্ছে Carina Nebula। এটি একটি স্টার তৈরী হওয়ার এলাকা, যার নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এখানে কি ঘটে। এটি পৃথিবী থেকে সাড়ে 7 হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। এই ছবিতে এমন অনেক স্টার রয়েছে যা হাবল ভার্সনে দেখা যায়নি।
কিন্তু এখনো হয়তো কারও কারও মনে প্রশ্ন রয়ে যেতে পারে, ছবিগুলোর গুরুত্ব তো বুঝলাম কিন্তু এই ছবিগুলো কি এডিটেড?
কিভাবে ছবিগুলোকে প্রসেস করে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়েছে? আমরা যেভাবে এই রঙিন ছবিগুলো দেখছি ওয়েব টেলিস্কোপ কিন্তু এভাবে ছবিগুলোকে দেখেনা। ওয়েব এই কসমিক অবজেক্টগুলো থেকে ইনফ্রারেড লাইট গ্রহণ করে সাদাকালো তথ্য হিসেবে, তারপর ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রোগ্রাম ইউজ করে ছবিগুলোর প্রকৃত রঙ ফুটিয়ে তোলা হয়।
ব্রডব্যান্ড কালার টেকনিক ইউজ করে যেমন বস্তুর প্রকৃত রঙ সামনে নিয়ে আসা হয়, তেমনি ন্যারোব্যান্ড কালার টেকনিক ইউজ করে স্টারগুলো কোন কোন এলিমেন্টে তৈরি বা তাদের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। যেহেতু রেড শিফটিং-এর ব্যাপারটি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দারুণভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে, তাই ওয়েবের তোলা এই ছবিগুলো মহাবিশ্ব সম্পর্কে রিয়েল এবং ডিটেলড ইনফরমেশন প্রকাশ করছে।
এটা তো কেবল শুরু মাত্র। ধারণা করা হচ্ছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আগামী 20 বছর মহাকাশে পর্যবেক্ষণের কাজ এভাবে চালিয়ে যাবে এবং নতুন নতুন আরও তথ্য আমাদের সামনে নিয়ে আসবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক / মোঃ গালীব হাসান
তথ্যসূত্র: vox.com, nasa.gov, James Webbs First Photos, Petapixel, Time