সাম্প্রতিককালে হার্ট ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অ্যানিউরিজম, পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ, হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এইসব রোগে ভুক্তভোগী ব্যক্তি প্রতিনিয়তই দেখা যায়। হৃদরোগ সম্পর্কে কমবেশি সবারই জানা আছে। একটু খোঁজ নিলে কোনো হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া যাবেনা এমনটা খুবই বিরল। হৃদরোগসমূহের হার দিনদিন এমন ভাবে বাড়ছে যে এর সম্পর্কে ছোট বড় অধিকাংশই সুপরিচিত। হৃদরোগ কে কার্ডিওভাস্কুলার রোগ-ও বলা হয়।
অনেক সময়ই এইসব কার্ডিওভাস্কুলার রোগ সম্পর্কে পূর্ব সতর্কতা না থাকায় ও চিহ্নিতকরণের ত্রুটিতে অনেকের তাৎক্ষণিক মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়। আফ্রিকা ব্যতীত বিশ্বমৃত্যুর প্রধান কারণ এই কার্ডিওভাস্কুলার রোগ। অনুমান করা হয় যে ৯০% পর্যন্ত কার্ডিওভাস্কুলার রোগ প্রতিরোধযোগ্য হতে পারে।
এই কার্ডিওভাস্কুলার রোগ সারা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। এরই চিকিৎসাক্ষেত্রে নতুন এক যন্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা যার মাধ্যমে আরও সঠিকভাবে রোগের সম্ভাবনাসমূহকে চিহ্নিত করে প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
গবেষণার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা একটি নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন যা QR4 নামে পরিচিত। এটি একজন ব্যক্তির হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো কার্ডিওভাস্কুলার রোগের দশ বছরের ঝুঁকি সম্পর্কে আরও সঠিকভাবে তথ্য প্রদান করে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের চিহ্নিত করতে পারে। যেসব তথ্য বর্তমানে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলোর দ্বারা বাদ পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি একটি কার্ডিওভাস্কুলার ঝুঁকির পূর্বাভাস প্রদানকারী সরঞ্জাম। যা যুক্তরাজ্যের ১৬ মিলিয়নেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল।
গবেষণাটি সম্প্রতি নেচার মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে ও নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনের প্রাইমারি কেয়ার মেডিকেল স্ট্যাটিস্টিকসের অধ্যাপক ডক্টর ক্যারল কুপল্যান্ডের সহ-নেতৃত্বে সম্পাদন করা হয়েছে।
QR4 কে একধরণের ক্যালকুলেটর হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে কেননা এটি কার্ডিওভাস্কুলার রোগের সম্ভাবনার স্কোর গণনা করে। পরবর্তী ১০ বছরে কার্ডিওভাস্কুলার রোগের সম্ভাবনা আঁচ করার জন্য রোগীর স্বাস্থ্যের ডেটা, যেমন রক্তচাপ, বয়স এবং চিকিৎসা ইতিহাস ব্যবহার করে। এটি সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য চারটি নতুন ঝুঁকির ধরণ অন্তর্ভুক্ত করে সেগুলো হলো-
১। ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি (একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক ফুসফুসের রোগ, যা ফুসফুসে বায়ুপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে)
২। শেখার অক্ষমতা
৩। ডাউন সিনড্রোম (একটি জেনেটিক রোগ যেখানে ২১ নং ক্রোমোজোমে আরেকটি অতিরিক্ত ক্রোমোজোম বিদ্যমান। এই রোগে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে)
৪। চার ধরনের ক্যান্সার (রক্ত, ফুসফুস, মুখ এবং মস্তিষ্ক)
QR4 মহিলাদের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যতে কার্ডিওভাস্কুলার রোগের পূর্বাভাস দেয় এমন কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে যেমন, গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ এর কারণে জটিলতা এবং প্রসবোত্তর বিষণ্নতা, প্রি-এক্লাম্পসিয়া (গর্ভধারণ জনিত জটিলতা যা গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পরে কিংবা শিশু জন্মের পরে দেখা দেয়। এতে প্রায়ই উচ্চ রক্তচাপ এবং একইসাথে মূত্রে প্রোটিন পাওয়া যায়)।
গবেষণাটির প্রধান লেখক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নুফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অফ প্রাইমারি কেয়ার হেলথ সায়েন্স এর ক্লিনিক্যাল এপিডেমিওলজি অ্যান্ড জেনারেল প্র্যাকটিস এর অধ্যাপক ডা.জুলিয়া হিপিসলে কক্স বলেছেন,
“যদিও প্রথাগতভাবে কার্ডিওভাস্কুলার ঝুঁকির কারণ হিসেবে ধূমপান ও উচ্চ কোলেস্টেরল স্বীকৃত, এবং আমাদের আমাদের সর্বশেষ গবেষণা এখনও সুস্পষ্ট নয়, তবুও আমরা ঝুঁকিপূর্ণ সূচকগুলো চিহ্নিত করছি।”
উদাহরণস্বরূপ, প্রসবোত্তর বিষণ্নতা এবং ডাউন সিনড্রোমের মতো অবস্থাগুলো কার্ডিওভাস্কুলার ঝুঁকিতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে।
QR4 নামক এই নতুন যন্ত্রটির মূল্যায়নের জন্য অ্যালগরিদমটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ উভয় স্থানে সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হৃদরোগের ঝুঁকি মূল্যায়নের সরঞ্জামগুলোর সাথে কঠোর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছিলো। এটি যুক্তরাষ্ট্রের NICE দ্বারা সুপারিশকৃত QRISK সহ বহু কার্ডিওভাস্কুলার ঝুঁকি ক্যালকুলেটরকে ছাড়িয়ে আরও সঠিকভাবে উচ্চ ঝুঁকির রোগীদের শনাক্ত করতে সম্ভব হয়েছিলো।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওভাস্কুলার মেডিসিনের বিএইচএফ প্রফেসর কিথ চ্যানন বলেন,
“নতুন ফলাফলগুলো আরো বিভিন্ন ধরনের উচ্চ কার্ডিওভাস্কুলার ঝুঁকিযুক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। যা তাদের চিকিৎসার পথ আরো সুগম করে তুলবে।”
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র গবেষক এবং নটিংহাম ইউনিভার্সিটির প্রাইমারি কেয়ারে মেডিকেল স্ট্যাটিস্টিকসের অধ্যাপক এবং গবেষণার সহ-লেখক ড. ক্যারল কুপল্যান্ড বলেন,
“QR4 মডেল সম্ভাব্যভাবে কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকির পূর্বাভাস সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে একটি নতুন মান নির্ধারণ করবে।”
প্রতিষ্ঠিত মডেলগুলোর সাথে QR4 এর তুলনা করলে দেখা যায় যে QR4 প্রতিটি ব্যক্তির জন্য আরও বিশদ ফলাফল প্রদান করে যেখানে ঝুঁকিগুলো উল্লেখ করা থাকে। এর মাধ্যমে রোগটির সম্ভাবনা ও ধরণ আরও সুস্পষ্ট হয়ে যায় এবং এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আরও উন্নত করা সম্ভব হয়। এটি আরও সূক্ষ্ম এবং নিরাপদ চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একটি নতুন মাইল ফলক তৈরি করে৷
কার্ডিওভাস্কুলার রোগ প্রতিরোধে চিকিৎসা পদ্ধতি উন্নতি করার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাদিয়া সুলতানা হিমু / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র : মেডিকেল এক্সপ্রেস, অক্স.এসি.ইউকে, নটিংহাম.এসি.ইউকে, মেডিসাই.অক্স.এসি.ইউকে