কিছু মানুষ কেন তাদের হার মেনে নিতে চায় না? এটাও কী কোনো মানসিক রোগ?
Once upon a time, Alexander Pope said, “To err is human; to forgive, divine”.
আপাতদৃষ্টিতে আমরা এমন একটি যুগে বসবাস করছি যেখানে সবাই নিজের পরিপূর্ণতা তথা পারফেকশন খুজে থাকি। আমরা হার মানতে নারাজ। আমরা যদি মনের ভুলবশত কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবেও কিছু ভুল করে থাকি তবুও আমরা কেন যেন আমাদের পরাজয় মেনে নিতে পারি না।
কিন্তু কেন? আমাদের শিরায় কি এমন বয়ে চলছে যার ফলে আমরা নিজেদের ভুল বুঝে উঠতে পারছি না!
‘দ্য ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি’র এক গবেষণায় প্রদর্শিত হয়, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষমা চাওয়ার চেয়ে ভুল স্বীকার করা কঠিন হয়ে দাড়ায়।
এছাড়াও, মনোবিজ্ঞানী Roy Lewick এবং Leah Polin উদ্ভাবন করেন কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে “আমাকে মাফ করে দাও” বলার চেয়ে “তুমি ঠিক বলেছিলে কিন্তু আমিই ভুল করেছি” বলাটা খুব বেদনাদায়ক মনে হয়।
তবে এর পিছনে কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে যার কারনে মানুষ তাদের ভুল স্বীকার করে না। যেমনঃ
১. নার্সেসিজম (Narcissism)
নার্সেসিজম শব্দটির সাথে আমরা কম-বেশি অনেকেই পরিচিত। মূলত স্বার্থপরতা, নিজের অধিকারবোধ আদায়, কারও সহানুভূতি ও প্রশংসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি নার্সেসিজম এর আওতাভুক্ত।
মূলত যারা নার্সেসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসওর্ডার এ ভোগে তাদের কে নার্সেসিস্ট বলা হয়।নার্সেসিস্টিক ডিসওর্ডার হলো বিভিন্ন ব্যক্তিত্বজনিত ব্যাধিগুলোর মাঝে একটি – যেখানে একজন ব্যক্তি নিজের গুরুত্বকে সবচাইতে বেশি প্রাধান্য দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।এর ভেতর আছে অন্যের প্রতি সহানুভূতির অভাব, নিজেকে বড় মনে করা, নিজের দোষ ঢাকতে অন্যকে দোষারোপ করা ইত্যাদি। Self admiration, Egocentrism, Arrogance, Envy, Lack empathy এই প্রতিটি শব্দের বাহক একজন নার্সেসিস্ট।
২. ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধহীনতা (Personal Irresponsibility)
ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধহীনতা প্রকৃতপক্ষে মানসিক অপূর্ণাঙ্গতা (immaturity) এবং সোশ্যাল স্কিল এর অভাবের সাথে সম্পৃক্ত। যাদের মধ্যে সোশ্যাল স্কিলস এর ঘাটতি থাকে তারাই তাদের দোষ স্বীকার করতে চায় না।
৩. ডিফেন্স মেকানিজম (Defense Mechanism)
ডিফেন্স মেকানিজম হলো একধরনের মানসিক প্রক্রিয়া (Mental Process) যা অবচেতনভাবে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব বা ঝগড়া হতে নিজেকে এড়িয়ে নেওয়াকে বুঝায়।‘ইউরোপীয়ান জার্নাল অব সোশ্যাল সাইকোলজি’ তে ডিফেন্স মেকানিজম নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে বলা আছে, কিছু ব্যক্তির জ্ঞানে অসঙ্গতি বা ত্রুটি থাকার পরও তারা তাদের অহমিকা (Ego) রক্ষার জন্য চুপ থাকে। এমনকি তারা তাদের ব্যর্থতাও প্রকাশ্যে আসতে দেয় নি।
উপরোক্ত কারনগুলো ছাড়াও কতক ব্যক্তির মধ্যে একধরনের ফোবিয়া দেখা দেয়। এই ফোবিয়ার ফলে তারা নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে না।
অ্যাটাইকিফোবিয়া (Atychiphobia):
অ্যাটাইকিফোবিয়া বলতে নিজের ব্যর্থতার প্রতি ভয় পাওয়াকে বোঝায়। যদি কেউ নিজের ব্যর্থতার প্রতি ক্রমাগত ভয় পেয়ে থাকেন তাহলে সে অ্যাটাইকিফোবিয়া তে আক্রান্ত। তবে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার প্রতি ভয় মূলত mood disorder, anxiety disorder এবং eating disorder এর উপর নির্ভর করে। যারা সবকিছুতে পারফেকশনের সন্ধান করে থাকে তাদের মধ্যে এই ধরনের ফোবিয়ার প্রবনতা বেশি।
পৃথিবীতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিই অ্যাটাইকিফোবিয়াতে আক্রান্ত থাকে (আমেরিকান জনগোষ্ঠীর ২-৫ ভাগ এই ফোবিয়াতে আক্রান্ত)। যারা এই ফোবিয়াতে ভোগেন তাদের ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকে দমন করা খুব কষ্টকর। অ্যাটাইকিফোবিয়া তে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে কিছু লক্ষ্মণ প্রদর্শিত হয় যেমনঃ অনিয়ত হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, বমি-বমি ভাব, নার্ভাসনেস, পেট-ব্যথা, ঘর্ম নিঃসরণ, পেশির উত্তেজনা, পুরো শরীর কম্পন ও মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
অ্যাটাইকিফোবিয়ার সম্ভাব্য কিছু কারণ থাকতে পারে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো- ছোটবেলা থেকে বাবা-মা কিংবা পরিবারের কাছের সদস্যদের দ্বারা অপমানিত ও নির্যাতিত হওয়া, যেকোনো বিব্রতকর ও মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও, জেনেটিক্যালি অনেকের মধ্যেই উদ্বিগ্নতা বেশি থাকে যার পরিনতি অ্যাটাইকিফোবিয়া।
এই ধরনের ফোবিয়া অনেকটা ওসিডি (OCD) ডিসঅর্ডার এর সাথে সম্পৃক্ত।অ্যাটাইকিফোবিয়ার চিকিৎসা একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে এবং ব্যক্তিভেদে এটি আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। সাধারণ চিকিৎসা হলো জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু চিকিৎসা হলো সাইকোথেরাপি, মেডিকেশন যা গ্রহণের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিছুটা হলেও এই ধরনের ভীতি পরাস্ত করতে পারবে।
যাই হোক, এক্ষেত্রে ব্যাপারটি এমন নয় যে অ্যাটাইকিফোবিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শুধু নিজেদের বড় করে দেখতে চান। সত্যি বলতে, তারা জীবনের অধিকাংশ সময়েই ডিপ্রেশন ও একাকীত্বে ভুগে থাকেন। অন্যের কাছ থেকে লাঞ্ছিত না হওয়ার জন্য তারা সবকিছুতে পরিপূর্ণতা খুজে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে, এই ফোবিয়ার জন্য তারা নিজেরা দোষী নয় বরং তার চারপাশের পরিবেশ এই জন্য দায়ী। এমনকি এই ফোবিয়ার সাধারন কোনো চিকিৎসা নেই।
তাই আমাদেরকে তাদের প্রতি যেমন হতে হবে সহানুভূতিশীল তেমনি তাদেরকে এই মানসিক সমস্যা থেকে বের করিয়ে আনাটাই হবে একমাত্র প্রচেষ্টা।
তথাপি, নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির মধ্যে আত্মসম্মানবোধ, পরাজয় না হওয়ার প্রবনতা, ডিফেন্স মেকানিজম, অহমিকা ইত্যাদি বিষয়গুলোর প্রভাব থাকার কারনে তারা কোনো কিছুতে হার মানতে চায় না তথা ব্যর্থ হতে চায় না। মূলত তাদের ভুলগুলোর প্রতি আমরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাব সেটি আমাদের উপর নির্ভর করে। কিন্তু একটি জিনিস আমাদের করা উচিত নয় যা হলো তাদের ভুলগুলো জেনেও চুপ থাকা এবং ভুলগুলো শুধরিয়ে না দেওয়া। যার ফলস্বরূপ আমরা পরোক্ষভাবেই হয়ে উঠি তাদের দম্ভের কারন।
তথ্যসুত্রঃ হেলথলাইন ডট কম এবং সাইকোলজি টুডে
সামসুন নাহার প্রিয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক / ডেইলি সাইন্স