স্মৃতি না থাকলে আমরা হয়তো হারিয়ে যেতাম। এটি আমাদের জীবনের যোগসুত্রকে আঁকড়ে রাখে, আমরা কে ছিলাম থেকে আমরা কারা পর্যন্ত!
তবে সম্প্রতি গবেষকরা এই অসাধারণ বিষয়ের পেছনের বিজ্ঞানকে একসাথে করেছেন – এটি এমন একটি গল্প যা অ্যামনেসিয়া বা স্মৃতি বিস্মৃতি, মাইন্ড প্যালেস এর জগতে নিয়ে যায়।
স্মৃতি সম্পর্কে সর্বপ্রথম উপমা এসেছে প্রাচীন গ্রীকদের থেকে, যেখানে প্লেটো স্মৃতিকে মোমের স্লেটের উপর নকশা করার সাথে তুলনা করেছেন। এবং তার প্রিয় ছাত্র অ্যারিস্টটল নিজের লেখায়ও এটা তুলে ধরেছিলেন। অ্যারিস্টটল ভেবেছিলেন, স্মৃতি শুধু মস্তিষ্কের মধ্যেই থাকে না, বরং দেহের সর্বত্রই থাকে! এবং মস্তিষ্ক কেবলমাত্র উত্তপ্ত হৃদয়কে শীতল করার জন্য – আমাদের আত্মা হলো সব!
জার্মান দার্শনিক হারমান এব্বিংস ১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে স্মৃতির উপর প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুচনা করেছিলেন। এব্বিংস তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গবেষনার জন্য ২০০০ এরও বেশি খারাপ বা বাজে শব্দের একটি লিস্ট করেন, যেগুলো তিনি মুখস্ত করেছিলেন, পরবর্তীতে এগুলো মনে করার চেষ্টা করেন। তিনি আবিষ্কার করেন যে, আমরা ভুলে যাই একটি ব্যাখ্যামুলক ভাবে, তা হলো আমরা শেখার একটু পরই অনেক কিছু ভুলে যাই, এবং সময়ের সাথে আস্তে আস্তে বাকিটুকুও ভুলে যাই!
মনোবিজ্ঞানে তিনি তিন ধরনের স্মৃতি বর্ণনা করেছেন-
১) সংবেদনশীল স্মৃতি
২) স্বল্প-মেয়াদী স্মৃতি এবং
৩) দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি
সংবেদনশীল স্মৃতি হলো, যা আপনার মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং সেকেন্ডের কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। আপনার ত্বকের উপর জামার স্পর্শ, আগুনের গন্ধ। কোনো বিষয় নিয়ে আপনি চিন্তা করলে সেটা আপনি আপনার স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিতে ঠেলে দেবেন।
আমাদের স্বল্প-মেয়াদী স্মৃতি প্রায় সাতটি তথ্য মনে রাখতে পারে যা মনের মধ্যে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড থাকে। এই কাজগুলোকে পুনরাবৃত্তি করতে থাকলে এগুলো আপনার দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে রূপান্তরিত হতে পারে।
স্মৃতিশক্তির থিওরী সমুহঃ
বিংশ শতকেও বিভিন্ন বিজ্ঞানী স্মৃতি সম্পর্কিত গবেষণাগুলো চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফ্রেডরিক বার্টলেট নামের ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী।
১৯১৪ সালে, তিনি একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন, যেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের একটি গল্প পড়তে এবং স্মৃতি থেকে রিপিট করতে বলেছিলেন এবং দেখেছিলেন দিন, মাস এবং বছর শেষে গল্পটি কীভাবে রূপান্তরিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আমরা আসলে কেবলমাত্র মূল তথ্যের একটি ছোট্ট অংশ মনে রাখি, ব্যক্তিগত জ্ঞানের দ্বারা বাকি শূন্যস্থান পূরণ করি।
কিন্তু কীভাবে মানুষের স্মৃতিশক্তি কাজ করে তার এত এত গবেষণা সত্ত্বেও, অনেক প্রশ্ন থেকেই যায়। স্মৃতি কোথায় সংরক্ষণ করা হয়? স্মৃতি দেখতে কেমন? এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী কার্ল ল্যাশলি তার সারা জীবন ব্যয় করেছিলেন।
ল্যাশলি তার জীবনভর গবেষণায় দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, আমাদের মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশের টিস্যু নষ্ট করে দিলে আমাদের স্মৃতিরও কিছু অংশ সারা জীবনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি তার এই মতবাদ প্রমাণের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু অসাধারণ পরীক্ষা চালিয়েছিলেন।
তিনি ইঁদুরদের একটি গোলকধাঁধা থেকে কীভাবে বের হতে হয় এর উপর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং তারপর তাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ নষ্ট করে দিচ্ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন তিনি যদি স্মৃতির সেই নির্দিষ্ট অংশ ধ্বংস করতে সক্ষম হন তবে ইঁদুরগুলো তাদের জানা পথ ভুলে যাবে এবং আর গোলকধাম থেকে বের হতে পারবে না।
কিন্তু এরপরও ইঁদুরদের মস্তিষ্কের ঠিক কোথায় তাদের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে তা তিনি বের করতে পারছিলেন না। ল্যাশলী তার সারা জীবন গবেষণার পরেও তার এই মতামতের পক্ষে কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালের দিকে এসে পরাজয় মেনে নেন এবং তার নতুন মত প্রকাশ করেন। নতুন করে তিনি বলেন, আমাদের স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কের ছোট একটি নির্দিষ্ট অংশে নয় গোটা মস্তিষ্কেই ছড়িয়ে থাকে।
যে নিউরনগুলো একসাথে কাজ করে, তারা একসাথেই থাকে। ১৯০৬ সালে, ক্যামিলো গোলগি এবং সান্তিয়াগো রমন ওয়াই কাজলকে কোষের স্টেইনিং কৌশলগুলির অগ্রগতির মাধ্যমে নিউরনের গঠন দেখানোর জন্য যৌথভাবে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল। তারা আবিষ্কার করেছিলেন নিউরনগুলো কিভাবে যুক্ত থাকে।
১৯৪৯ সালে ডোনাল্ড হেব গত শতাব্দীতে নিউরোসায়েন্সের সবচেয়ে প্রভাবশালী তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, “একই সাথে কাজ করতে থাকা মস্তিষ্কের যে কোনও দুটি কোষ ‘যুক্ত’ হয়ে যায়।”
আরও পড়ুনঃ ১। বোবাই ভূত বা স্লিপ প্যারালাইসিস কী? এর থেকে মুক্তির উপায় |
একই সময়ে, কানাডিয়ান সার্জন ওয়াইল্ডার পেনফিল্ড প্রমাণ করেছিলেন, কিভাবে কর্টেক্সের উত্তেজক অংশগুলি স্মৃতি জাগাতে পারে। তিনি সার্জারি চলাকালীন সময়ে জেগে থাকা মৃগী রোগীদের অপারেশন করেছিলেন। এক মহিলার উপর অপারেশন করার সময় তিনি কর্টেক্সের মধ্যে হিপ্পোক্যাম্পাসের একটি অঞ্চলকে উদ্দীপিত করেছিলেন।
দেখা যায়, পেনফিল্ডের প্রয়োগ করা এই স্টিমুলেশন তার দীর্ঘ-বিস্মৃত স্মৃতিগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলছে – যেমন ধূলিকণায় ঢাকা একটি অ্যালবাম থেকে এলোমেলোভাবে একটি ছবি তুলে নেবার মতো।
নব্বইয়ের দশকে, তিনি দেখিয়েছিলেন যে মানুষের মনে ভ্রান্ত স্মৃতি প্রবেশ করানো যেতে পারে। যেমন নকল দমবন্ধ, নিকটে ডুবে যাওয়া, পৈচাশিকতা ইত্যাদি। তিনি দেখিয়েছেন যে ক্লান্তি, মাদকদ্রব্য এবং নিম্ন আইকিউ এগুলোর উপরেই নির্ভর করে কতটা মিথ্যা স্মৃতি কেউ গঠন করতে পারে।
তার কাজটি বেশ অসাধারণ কিছু ফলাফল প্রকাশ করেছিল; আমাদের স্মৃতিগুলি একবারে চিরস্থায়ী নয়। প্রতিবার যখন আমরা কোনও স্মৃতি পুনরায় মনে করি, তখন এটি আমাদের তৈরি করা নিউরাল সংযোগগুলিকে আরও শক্তিশালী করে ফলে এটি আমাদের মনে আরও স্থায়ীভাবে থেকে যায়।
হিপ্পোক্যাম্পাস: যেখানে স্মৃতি গঠিত হয়
উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে নিউরন ম্যাপিং এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন মস্তিষ্কের কোথায় স্মৃতিগুলি সংরক্ষণ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, যখন মানুষ নতুনভাবে কিছু শিখে এবং পরে তা স্মরণ করার চেষ্টা করে, তখন বিষয়গুলো শিখার সময় যাদের হিপ্পোক্যাম্পাস সর্বাধিক কার্যকর ছিলো, তারা তা ভবিষ্যৎএ সবচেয়ে ভালো মনে রাখতে পারে। সময়ের সাথে সাথে এই স্মৃতিগুলো কর্টেক্সে যায় ও আরও স্থায়ী হয়।
২০১৭ সালে, তাকাশি কিতামুরার নেতৃত্বে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষকরা দেখিয়েছেন যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি আসলে একই সাথে গঠিত হয়। কিতামুরার টিম ‘অপটোজেনটিক্স’ নামের একটি নতুন কৌশল ব্যবহার করে প্রশিক্ষিত ইদুরদের উপর পরীক্ষা করেছেন। দলটি ইদুরগুলোকে একটি ছোট বৈদ্যুতিক শক দিয়ে একটি নির্দিষ্ট চেম্বারকে ভয় করতে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
প্রশিক্ষণের পরে গবেষকরা হিপোক্যাম্পাস এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স উভয়ের মধ্যে কপালের ঠিক পিছনে একটি অঞ্চলে শকের স্মৃতি দেখতে পেয়েছিলেন। তবে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের স্মৃতি কোষগুলি নীরব থাকে।
স্মৃতি ধীরে ধীরে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে, কর্টেক্সের মেমোরি কোষগুলোর আকৃতি এবং ক্রিয়াকলাপ পরিবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ী হয় এবং শেষ পর্যন্ত নিজেরাই সক্রিয় হয়ে ওঠে যখন ইঁদুরটি চেম্বারের মুখোমুখি হয়। এই মূহুর্তে হিপ্পোক্যাম্পাল মেমোরি কোষগুলো নীরব হয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যের অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের আলঝেইমার স্মৃতিভ্রংশের শীর্ষস্থানীয় কারণ। এই রোগটি নিউরনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগগুলি ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং বিভ্রান্তি ঘটে। আমাদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এর এখনও কোন নিরাময় নেই।
তবে, আপনার স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে পারে এমন কয়েকটি উপায় রয়েছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রফেসর ইলানোর মাগুয়ারের গবেষণায় দেখা গেছে যে বিশ্বের সেরা স্মৃতিবিদদের মস্তিষ্ক সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা নয়: তারা কেবল ‘লকি পদ্ধতি‘ নামে পরিচিত একটি প্রাচীন কৌশল ব্যবহার করে।
একই সাথে অনেক কিছু মনে রাখার খুব সহজ একটি উপায় হলো তাদেরকে আপনার খুব পরিচিত কোনো জায়গা বা বস্তুর সাথে মিলিয়ে সাজানো। একবার সাজানোর পর যখন আপনার এই জিনিসগুলো আবার মনে করা প্রয়োজন হবে, তখন সহজেই সেই পরিচিত জায়গা বা বস্তুর মাধ্যমে আপনি তা মনে করতে পারবেন! নিজে এটি চেষ্টা করে দেখুন, এই পদ্ধতিতে চেষ্টা করে আপনি “সুপার মেমোরাইজার” হয়ে উঠতে পারেন!
স্মৃতি নিয়ে এতসব গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিলো এর রহস্যময়তা জানা। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে স্মৃতি নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছেন, যা বিভিন্ন স্মৃতিজনিত রোগের চিকিৎসা বা, মাদকাসক্তির চিকিৎসায় অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে তারা আশাবাদী।