স্পাইডার সিল্ক, শুনলেই মাথায় আসে, আরে মাকড়সার আবার কিসের সিল্ক!! কিন্তু জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে তৈরি ব্যাকটেরিয়া, স্টিল বা ইস্পাতের চেয়ে শক্তিশালী এবং কেভলারের চেয়েও শক্ত ফাইবার তৈরি করতে সক্ষম, এমনকি তা ছাড়িয়ে যাচ্ছে স্পাইডার সিল্ক কে-ও!! সিল্ক মূলত প্রোটিন ভিত্তিক প্রাকৃতিক তন্তু যা বেশ কয়েক ধাপ প্রক্রিয়ার পর সুতা হিসেবে পাওয়া যায়। তবে শুনে অবাক লাগতে পারে, সিল্কের মতো এমন সুতা মাকড়সা থেকেও এখন পাওয়া সম্ভব, যা সম্প্রতি পরিচিত হয়েছে ‘স্পাইডার সিল্ক’ নামে।
কিছুটা অবাস্তব আর আষাঢ়ে গল্পের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু এটি সত্য যে, মাকড়সা থেকে প্রাপ্ত সুতা স্টিলের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, স্পাইডার সিল্কগুলো এতটাই শক্তিশালী যে, পেন্সিলের প্রস্থচ্ছেদ বিশিষ্ট স্পাইডার সিল্কের একটি সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ড উড়ন্ত Boeing 747 কে থামিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। এই স্পাইডার সিল্কের মধ্যে সবচেয়ে বেশি Tensile strength সমৃদ্ধ সিল্ক হল ড্রাগনলাইন সিল্ক যা কিনা Golden Silk Orb-Weaver নামের এক ধরনের স্পাইডার বা মাকড়সা (বৈজ্ঞানিক নাম: নেফিলিয়া ক্ল্যাভিপস) থেকে সৃষ্ট। এমনকি “কেভলার” নামক কৃত্রিম সুতা, যা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তৈরীতে কাজে লাগে, তার থেকেও স্পাইডার সিল্ক বেশি দৃঢ়।
তবে সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়াররা একধরণের অ্যামাইলয়েড সিল্ক হাইব্রিড প্রোটিন ডিজাইন করেছেন এবং সেগুলো উৎপাদনের জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া তৈরি করেছেন। ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রাপ্ত সেই ফাইবার প্রাকৃতিক মাকড়সার ফাইবার সিল্ক থেকেও শক্তিশালী এবং শক্ত।
স্পাইডার সিল্ক দিয়ে পোশাক বানানো সম্ভব এই বিষয়টা আগে টেক্সটাইল শিল্পে কল্পনাই করা যেত না কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হয়েছে। এই স্পাইডার সিল্ক অবিশ্বাস্যরকমের Tensile strength সমৃদ্ধ এবং একই ব্যাস আর ওজনে স্টিলের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি শক্তিশালী।
আর এটির প্রোটিন স্ট্রাকচার অন্যান্য স্পাইডার সিল্ক থেকে আলাদা আর কেমিক্যাল বন্ড অনেক দৃঢ় হওয়ার কারনে এই ড্রাগনলাইন সিল্ক এর Tensile strength তুলনামূলক ভাবে একটু বেশিই থাকে। তাই মাকড়সার সিল্ককে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী, শক্ততম উপকরণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
তবে সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়াররা একধরণের অ্যামাইলয়েড সিল্ক হাইব্রিড প্রোটিন ডিজাইন করেছেন এবং সেগুলো উৎপাদনের জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া তৈরি করেছেন। ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রাপ্ত সেই ফাইবার প্রাকৃতিক মাকড়সার ফাইবার সিল্ক থেকেও শক্তিশালী এবং শক্ত। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, কৃত্রিমভাবে তৈরি সিল্ক – যাকে “পলিমারিক অ্যামাইলয়েড” ফাইবার বলে, যা আসলে গবেষকরা সরাসরি তৈরি করেননি বরং জৈবিকভাবে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি হয়েছিল। যে ব্যাকটেরিয়া ম্যাককেলভে স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর জ্বালানী, পরিবেশ ও রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ফুজং জাং এবং তার দল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে তৈরি করেন।
অধ্যাপক জাং এর আগেও মাকড়সার সিল্ক নিয়ে কাজ করেছেন। ২০১৮ সালে, তাঁর ল্যাবে করা গবেষণায় তিনি এমন একটি ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে সক্ষম হন, যা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন মাকড়শার তৈরি সিল্কের সেরা-সেরা বৈশিষ্টগুলি নিয়ে এক রিকম্বিনেন্ট মাকড়শার সিল্ক তৈরি করতে সম্ভব।
অধ্যাপক জাং বলেন, “আমাদের আগের কাজ করার পরে, আমি ভেবেছিলাম যে আমরা হয়তো আমাদের সিন্থেটিক বায়োলজি প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে মাকড়সার সিল্কের চেয়ে আরও ভাল এবং শক্তিশালি কিছু তৈরি করতে পারি।”
অধ্যাপক জাং এর ল্যাবের পিএইচডি শিক্ষার্থী জিঙ্গিয়াও লি গবেষণা দলেটির গবেষণা পত্র লেখার নেত্তৃত্বে ছিলেন। গবেষণা দলটি মাকড়সার সিল্কের প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিডকে মডিফাই করেন। এবং তাতে আগের কিছু প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ঠ্য রেখে নতুন কিছু বৈশিষ্ঠ্য যোগ করেন।
তবে মডিফাই করে তৈরি করা এই রিকম্বিন্যান্ট স্পাইডার সিল্ক ফাইবারের একটি সমস্যা আছে। মূলত প্রাকৃতিক মাকড়সার সিল্কের একটি প্রধান উপাদান β-nanocrystal যা এর শক্তিতে অবদান রাখে। তো সেই β-nanocrystal কে ধরে রাখতে প্রাকৃতিক মাকড়সার সিল্কের সিকুয়েন্স থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছাড়াই তৈরি করতে হবে এই রিকম্বিন্যান্ট স্পাইডার সিল্ক।
অধ্যাপক জাং বলেন, “মাকড়সারা প্রাকৃতিকভাবেই কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে ন্যানোক্রিসটাল দিয়ে ফাইবারগুলো কীভাবে স্পিন করতে পারে তা নির্ধারণ করতে শিখেছে। কিন্তু যখন মানুষ কৃত্রিম স্পিনিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে তখন সিন্থেটিক সিল্ক ফাইবারে ন্যানোক্রাইস্টালের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকে।“
এই সমস্যাটি সমাধান করার জন্য, দলটি β-nanocrystal গঠনে উচ্চ প্রবণতাযুক্ত এক অ্যামাইলয়েড সিকোয়েন্স যুক্ত করে সিল্ক সিকোয়েন্সের নতুন করে ডিজাইন করে। তারা প্রভাবক হিসাবে তিনটি অ্যামাইলয়েড সিকোয়েন্স ব্যবহার করে বিভিন্ন পলিমারিক অ্যামাইলয়েড প্রোটিন তৈরি করেন। ফলস্বরূপ প্রোটিনগুলো মাকড়সার সিল্ক তুলনায় অ্যামিনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স কম থাকে, যেটা ইঞ্জিনিয়ারিং করা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদন সহজতর করে তোলে।
শেষ পর্যন্ত, ব্যাকটেরিয়া ১২৮ টি অ্যামিনো অ্যাসিড সিকোয়েন্সের ইউনিট সহ একটি হাইব্রিড পলিমারিক অ্যামাইলয়েড প্রোটিন তৈরি করে। প্রোটিনে শিকল যত দীর্ঘ হবে তত শক্তিশালী এবং শক্ত ফাইবার তৈরি করবে। ১২৮-অ্যামিনো অ্যাসিড সিকোয়েন্সের ফলে গিগাপ্যাসকেল (GPa) শক্তি (নির্দিষ্ট ব্যাসের একটি ফাইবার ভাঙতে কতটা বল প্রয়োজন সে হিসেবে গিগাপ্যাসকেল স্কেলে)-র একটি ফাইবার তৈরি হয়, যা সাধারণ ইস্পাতের চেয়েও শক্তিশালী এবং কেভলার এবং পূর্ববর্তী সমস্ত রিকম্বিন্যান্ট সিল্ক ফাইবারের চেয়ে শক্ত। এর শক্তি এবং দৃঢ়তা কিছু উল্লিখিত প্রাকৃতিক মাকড়সার সিল্ক ফাইবারের চেয়েও বেশি।
শক্তি, পরিবেশ ও রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ইয়ং শিন জুন এবং তার পিএইচডি শিক্ষার্থী ইয়াগুয়াং জুয়ের সহযোগিতায় দলটি নিশ্চিত করেছে যে, পলিমারিক অ্যামাইলয়েড ফাইবারের শক্তিশালী হাই মেকানিকাল বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকৃতপক্ষে β-nanocrystal এর বাড়তি যে পরিমাণ তৈরি হয় সেটা থেকে আসে। দলটি জানায়, এই নতুন প্রোটিন এবং প্রাপ্ত ফাইবার, ‘উচ্চ-পারফরম্যান্স সমৃদ্ধ সিন্থেটিক ফাইবার’ তৈরির গল্প এখানেই শেষ নয়। ইহা তো সূচনা মাত্র।
অধ্যাপক জাং বলেন, “এটি প্রমাণ করে যে আমরা জীববিজ্ঞানের ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে এমন উপাদান তৈরি করতে পারি যা প্রকৃতির সেরা উপাদানকে পরাস্ত করতে পারে।“
হাজারো অ্যামাইলয়েড সিকোয়েন্সের মধ্যে গবেষণাটিতে মাত্র তিনটি অ্যামাইলয়েড সিকোয়েন্স নিয়ে কাজ করেছে। আর মাত্র তিনটি অ্যামাইলয়েড সিকোয়েন্সই এই প্রাকৃতিক মারড়সার সিল্ক ফাইবারের শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজে সৃদক্ষ এমন সীমাহীন বিভিন্ন ফাইবার তৈরি করা সম্ভব। এমনও হতে পারে, প্ল্যাটফর্মটি উন্নয়ণের ফলে যখন যেরকম ম্যাটারিয়াল প্রয়োজন হবে তা নিমিশেই ইঞ্জিনিয়ারিং করে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি করে ফেলা সম্ভব হবে।
মোঃ আজহার সিদ্দিক মেহরাজ/ নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্রঃ এটিটিসি
+1
+1
+1
3
+1
+1
1
+1
1
+1
1