বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে কিছুই যেন আর কোনো নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে আবদ্ধ নেই। প্রযুক্তি, বিনিয়োগ প্রবাহ, পন্য পরিবহন ইত্যাদি সবকিছুতেই রয়েছে বিশ্বায়নের ছোঁয়া। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে চালু হয় মেট্রোরেল। শহরের ভূ-তল দিয়ে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করে বিশ্বকে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। জাপানের টোকিওতে প্রায় শতবছর পূর্বে চালু হওয়া মেট্রোরেল এশিয়া মহাদেশে চালু হওয়া প্রথম মেট্রোরেল। আর বাংলাদেশে চালু হতে যাওয়া মেট্রোরেল ব্রিটিশ কলোনি থেকে দেড়শত বছর পিছিয়ে। জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে সামগ্রিকভাবে আমরা অন্য দেশ থেকে কার্যত অনেক পিছিয়েই আছি। এছাড়া ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাডার-স্যাটেলাইটের ব্যবহার বর্তমান সময়ে আমাদের জীবনের সকল ধাপকে করে চলেছে সমৃদ্ধ।
কিন্তু আমরা কি জানি, এই প্রযুক্তির সকল আশীর্বাদ একমুহুর্তেই মুছে যেতে পারে? রাডারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন, কিংবা বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ধ্বস, সেকেন্ডেই সকল বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারের বিস্ফোরণ এমনকি স্যাটেলাইট, টেলিফোন সকল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এক মুহূর্তে মাটি হয়ে যেতে পারে! একটি শক্তিশালী সৌরঝড়ের প্রভাবে নীল এ গ্রহে নেমে আসতে পারে বিপর্যয়!?
সৌরঝড় মূলত কী?
সৌরজগতের কেন্দ্র সূর্য থেকে লাগাতার তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ (গামা, রঞ্জন, প্রোটন, ইলেকট্রন) নিঃসরিত হতে থাকে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সূর্য থেকে আসা এসকল তরঙ্গ কণা মেরুতে পাঠিয়ে দেয়। এর ফলে মেরু অঞ্চলে সহসাই দেখা মেলে অরোরার (বিচিত্র আলোক ঝলকানি)। কিন্তু সাধারণত প্রতি ১০০ বছরে একবার সূর্যের এই কণা প্রবাহ বেগ লাভ করে এবং রূপ নেয় সৌরঝড়-এ। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে বলা হয়, সি.এম.ই (করোনাল ম্যাস ইজেকশন)। সাধারণত এই কণাগুলো ঘন্টায় কয়েক মিলিয়ন মাইল পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারে।
স্মরণকালে মানুষের উপলব্ধি করা সবচেয়ে বড় সৌরঝড় আঘাত হানে ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে। ইংরেজ বিজ্ঞানী ক্যারিংটনের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় “ক্যারিংটন ইভেন্ট“। বিজ্ঞানী ক্যারিংটন সূর্যকে পর্যবেক্ষণকালে প্রায় ৫ মিনিট ধরে সূর্যের ব্লাকস্পট থেকে ক্রমাগত নির্গত হতে থাকা আলোকচ্ছটা দেখতে পান। সেই কণাগুলো ১৭.৬ ঘন্টায় প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার অতিক্রম করে পৃথিবীতে আঘাত হানে।
সূর্যের আলো নিঃসরণের এই ঘটনা পর্যবেক্ষণের ঠিক পরদিন টেলিগ্রাফ লাইনের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে। তখন অবশ্য ১ লক্ষ ২৪ হাজার মাইল টেলিগ্রাফ লাইন ছাড়া পৃথিবীতে তেমন কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ লাইন ছিল না। টেলিগ্রাফ বিপর্যয়ের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে রাতের আকাশে অদ্ভুত আলোক রশ্মির ঝলকানি দেখতে পাওয়ার খবর পাওয়া যায়, এটি মূলত “অরোরা” যেটা সাধারণত মেরু অঞ্চলে দেখা যায় (সূর্যের তরঙ্গকণা পৃথিবীর ম্যাগনেট ফিল্ডে আঘাত করলে এ আলোর উদ্ভব ঘটে)। কিন্তু তখনকার মানুষের এসকল জ্ঞান না থাকায় অনেকেই ধরে নেন আমাদের পৃথিবী হয়তো ধ্বংসের পথে।
কিন্তু বিজ্ঞানী ক্যারিংটন তার গতদিনের সূর্য পর্যবেক্ষণের সাথে এসকল ঘটনার মিল খুঁজে পান এবং বিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সৌরঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা আবিষ্কৃত হয়। ক্যারিংটন ইভেন্টে টেলিগ্রাফের মেশিনারিজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেগুলো থেকে বৈদ্যুতিক শক অনুভূত হতে থাকে। অরোরার প্রভাব এত বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল যে, মাঝ রাতেই অনেক স্থানের মানুষ ধরে নিয়েছিল যে ভোর হয়ে গেছে।
সৌরঝড়-এর প্রভাব:
সৌরঝড় সাধারণত সরাসরি মানবদেহে কোনো প্রভাব ফেলে না, তবুও যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্যাটেলাইট, জিপিএস, পাওয়ার স্টেশন, বিদ্যুৎ প্রবাহ এগুলোতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। বর্তমান সময়ে যে পরিমাণ বৈদ্যুতিক তার এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আমরা উপভোগ করছি, একটি শক্তিশালী সৌরঝড় এই প্রেক্ষাপট পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। ঠিক এই মুহূর্তে কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই যদি ক্যারিংটন ইভেন্টের সমশক্তিসম্পন্ন কোনো সৌরঝড় আঘাত হানে তবে পুরো পৃথিবীই সময়ের সাপেক্ষে পিছিয়ে যাবে এবং আরও একটি প্রযুক্তি বিপ্লবের মাধ্যমে এ সংকট মোকাবেলা করতে হবে।
তবে আশার কথা হলো, ক্যারিংটন ইভেন্টের মত শক্তিশালী সৌরঝড় প্রতি ৫০০ বছরে একবার এবং এর অর্ধেক শক্তিসম্পন্ন সৌরঝড় প্রতি ৫০ বছরে একবার পৃথিবীতে আঘাত হানে। বর্তমানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সূর্যকে সর্বদা পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং বড় কোনো সৌরঝড় আঘাত হানার কিছুটা পূর্বেই পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব এবং সেই অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতিও আংশিক কমানো সম্ভব। যদিও এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার কোনো প্রস্তুতি কিংবা পূর্ব অভিজ্ঞতা কারো ই নেই।
ফারদিন তালহা
তথ্যসূত্র: দ্যা সান, স্পেস ডট কম
+1
+1
+1
+1
+1
1
+1
+1