সোডিয়াম (Na) আমাদের দেহের জন্য একটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যা আমাদের প্রতিদিনের খাবারে ব্যবহৃত লবণে সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) হিসেবে থাকে। কিছু খাদ্য উপাদানে প্রাকৃতিকভাবেই লবণ থাকে আবার কিছু খাদ্যদ্রব্যে প্রক্রিয়াজাত করার সময় লবণ যুক্ত করা হয়। সোডিয়াম অনেক কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পুষ্টি উপাদান, কিন্তু অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ করার ফলে বাড়তে পারে রক্তচাপ, যা রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং হৃৎপিন্ড কে আরো বেশি পরিশ্রম করতে বাধ্য করে। এর ফলে হার্ট ফেইলিউর সহ নানা রকম হৃদরোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এর সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী যেসব প্রাপ্তবয়স্করা দৈনিক ২৩০০ মিলিগ্রামের কম Na গ্রহণ করেন (যা ১ চা চামচ লবণের সমপরিমাণ) তারা হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকেন না বা তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। ACC-American College of Cardiology এর নির্দেশিকা অনুযায়ী হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য Na গ্রহণ এর মাত্রা দৈনিক ১৫০০ মিলিগ্রাম এর কম।
সোডিয়াম আমাদের দেহে পানির ভারসাম্য রক্ষা করে। মেডিসিনের ভাষায় বলা হয়, Where sodium goes, water follows – কারণ Na এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে কোষ থেকে পানি বাইরে চলে আসে। ফলে শরীরে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়। রক্তের এই অধিক ঘনত্ব উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে এবং হৃৎপিন্ড কে আরো বেশি কাজ করতে হয়।
হৃৎপিন্ডের উপর এই চাপ ক্রমশ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। গবেষকদের মতে, অতিরিক্ত সোডিয়ামের পরিমাণ ধমনী শক্ত হয়ে যাওয়া এবং ধমনীগাত্রে চর্বি, কোলেস্টেরল জমাট বাধার জন্য দায়ী। এর অতিরিক্ত গ্রহণ স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণগুলোর একটি।
প্রায় ৩০০০ এর বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির উপর গবেষণায় দেখা যায়, তাদের ৮৯ শতাংশ ব্যক্তিই প্রস্তাবিত দৈনিক ১৫০০ মিলিগ্রামের বেশি Na গ্রহণ করেছেন এবং অনেকেই এই পরিমাণের দ্বিগুণ গ্রহণে অভ্যস্ত ছিলেন!
উচ্চ সোডিয়াম ডায়েট (High salt diet- HSD) পরীক্ষায় মডেল হিসেবে পুরুষ ও স্ত্রী ইঁদুর কে উচ্চ Na যুক্ত খাবার দেওয়া হয় এবং প্রায় ৮ সপ্তাহ পর তাদের হৃৎপিন্ড থেকে টিস্যু সংগ্রহ করা হয়। ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ইঁদুরের হৃৎপিন্ডের গঠন স্বাভাবিক হৃৎপিন্ডের গঠনের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ফলাফলে আরো দেখা যায় উচ্চ সোডিয়াম ডায়েট বিভিন্ন বিপাক, অনাক্রম্যতা ও ফাইব্রোসিস প্রভাবিত করার মাধ্যমে হৃৎপিন্ডের কাঠামো ও কার্যকারিতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং ইঁদুরে লিঙ্গভেদে নির্দিষ্ট হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টিতে প্ররোচিত করে।
Na শুধু পুষ্টি উপাদান হিসেবে নয়, এটি অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শোষণ, পেশি ও স্নায়ু সঞ্চালন, হৃদপেশি সঞ্চালন এবং বিপাকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষকদের মতে, অনেকেই জানেন না তারা যে খাবার খাচ্ছেন তাতে কতটুকু সোডিয়াম বিদ্যমান এবং তারা প্রতিদিন কী পরিমাণ Na গ্রহণ করেন এ বিষয়ে অবগত নন। খাবারের লেবেল পরীক্ষা না করে এবং এর পরিমাণ সম্পর্কে সচেতন না হয়ে অনেকেই অজান্তে অত্যধিক সোডিয়াম গ্রহণ করছে।
লবণ গ্রহণে সতর্ক হওয়া, সোডিয়াম ব্যবহার কমানোর প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু আমরা আসলে কি পরিমাণ সোডিয়াম গ্রহণ করছি তা নির্ণয় করা কিছুটা কঠিন। অনেক খাদ্যদ্রব্যে লবণের স্বাদ ছাড়াও নানা কারণে এর ব্যবহার করা হয়। বেকিং, ঘনত্ব বাড়ানো, কিউরিং, আর্দ্রতা ধরে রাখা, প্রিজারভেটিভ ইত্যাদি কারণে সোডিয়াম বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করা হয়। সোডিয়াম সমৃদ্ধ অনেক খাবারেই লবণাক্ত স্বাদ পাওয়া যায় না কিন্তু ঠিকই এতে অধিক পরিমাণ এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একটি সাধারণ রেস্তোরাঁর খাবারে ২০০০ মিলিগ্রাম বা তার বেশি সোডিয়াম থাকতে পারে, যা হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রস্তাবিত পরিমাণের চেয়ে বেশি।
খাদ্যতালিকায় এর পরিমাণ কমানোর জন্য তাজা উপাদান ব্যবহার করে বাড়িতে রান্না করা খাবার গ্রহণ করা উচিত। কম পরিমাণ সোডিয়াম আছে এমন উপাদান ব্যবহার করা, অধিক প্রয়োজন ছাড়া সোডিয়াম সমৃদ্ধ উপাদান ব্যবহার না করা, স্বাদ বাড়াতে ভেষজ মসলা ব্যবহার করা, প্রক্রিয়াজাত করা খাবারে থাকা সোডিয়াম সম্পর্কে সচেতন থাকা- এসব বিষয়ে মনোযোগী হতে বলছেন গবেষকরা। এই সাধারণ পদ্ধতিগুলো সামগ্রিক সোডিয়াম গ্রহণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে সুস্বাদু খাবার গ্রহণে অবদান রাখতে পারে।
খাবারে লবণ প্রতিস্থাপন করে স্বাদ ঠিক রাখার জন্য বিকল্প উপাদান ব্যবহার করা উচিত। লবণের পরিবর্তে লেবু বা টক স্বাদযুক্ত ফলের রস ব্যবহার করে খাবারের স্বাদ বাড়ানো যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন অন্তত ১ গ্রাম করে লবণ খাওয়া কমালে মারাত্মক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিভিন্ন কার্ডিওভাস্কুলার রোগ বিশ্বব্যাপী অসুস্থতা ও মৃত্যুর এক নম্বর কারণ। সোডিয়াম গ্রহণ নির্দেশনা মেনে চলা হৃদরোগজনিত মৃত্যুহার কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
তাফহীমা ফেরদৌস / নিজস্ব প্রতিবেদক
তথ্যসূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে, এসিসি.অর্গ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন